আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘মানবাধিকারকে একটি সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এটা শুধু আইন দিয়ে হবে না। সবার রিয়েলাইজেশন (উপলব্ধি), আত্মশুদ্ধি লাগবে।’
শনিবার (২৬ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে ‘হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির’ উদ্যোগে আয়োজিত ১১তম মানবাধিকার সম্মেলন-২০২৫ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বচ্ছতা লাগবে। আমাদের আত্মসমালোচনা করতে হবে, আত্মশুদ্ধি করতে হবে। এগুলোর সঙ্গে যখন আমরা আইনগত পরিবর্তন করব, প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন করব, তখন একটা সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন আসতে পারে।’
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘রাষ্ট্রের প্রধান ৩টি অঙ্গ সবচেয়ে আগে ফিক্সড করা দরকার। সেগুলো হলো- নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। আগে এ তিনটি অঙ্গের প্রবলেম সলভ (সমস্যা সমাধান) করতে হবে। এখানে প্রবলেম রেখে তথ্য কমিশন করে, হিউম্যান রাইটস কমিশন করে, সেমিনার সিম্পোজিয়াম করে কোনো লাভ হবে না।’
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা একটি বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘অনেকে মনে করে, মানবাধিকার বাস্তবায়ন ইউরোপে হয়েছে, আমেরিকায় হয়েছে। তারা নিজের দেশের ভেতরে করেছে। কিন্তু তারা সারা পৃথিবীতে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করার কাজে নিয়োজিত আছে।’
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার ভয়টা চলে গেলে তখন (সরকার) কি দানবে পরিণত হয়। সেটা আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট আমল থেকে আমরা বুঝতে পারি। যেটার কারণে আমাদের এক হাজারেরও বেশি ছাত্র-জনতাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে চিরস্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে হয়েছে। কত কঠিন ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের, তা উপলব্ধির সার্বিকভাবে চিন্তাচেতনার প্রয়োজন আছে। আমরা আশাবাদী থাকব। কিন্তু আমরা যেন ইউটোপিয়ান হয়ে না যাই।’
সেমিনারে ঢাবির আইন অনুষদের ডিন ড. মুহম্মদ একরামুল হক বলেন, ‘কাগজে অনেক কথা লেখা থাকে। আমরা চাই, প্রোপার ইমপ্লিমেন্টেশন (বাস্তবায়ন)। মানবাধিকার যদি লঙ্ঘন হয়, তাহলে বিচার হবে আদালতে। কিন্তু আদালতকে যদি আমি ফ্যাসিজমের (স্বৈরাচারের) একটা অংশ করে ফেলি, তাহলে আমি সংবিধানে যতই ভালো কথা লিখি, সেটি কোনোদিন হবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত।’
তিনি বলেন, ‘হিউম্যান রাইটস এনফোর্সমেন্টের (মানবাধিকার প্রয়োগ) জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা বিশাল রোল (ভূমিকা) আছে। তাদের (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) বলতে হবে যে, আমি কোনো দলের দাস হিসেবে কাজ করব না, আমি আইন অনুযায়ী চলব।’
মুহম্মদ একরামুল হক আরও বলেন, ‘২০২৪ সালে অথোরিটারিয়ান রেজিম (কর্তৃত্ববাদী শাসনে) পতনের পর দেশের সামনে বিরল এক মোমেন্টাম এসেছে। এখন সময় দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী গভর্নেন্সে (সরকারে) জবাবদিহিতা ও সংস্কার আনার। এসবের মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের দিকে এগিয়ে যাওয়া যাবে।’
সেমিনারে আওয়ামী শাসনামলে গুম হওয়া ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম (আরমান) ও মাইকেল চাকমা, গণঅভ্যুত্থানে আহত দুই জুলাই যোদ্ধা এবং শহীদ নাইমা সুলতানা এবং শাহরিয়ায় খানের মা বক্তব্য দেন।
শহীদ শাহরিয়ার খানের মা সানজিদা খান তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা এমন রাষ্ট্রে বাস করি, যেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। আমার ট্যাক্সের টাকায় কেনা গুলি আমার সন্তানের বুকে বিদ্ধ হয়েছে, আমার দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী আমার সন্তানের ঘাতক। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমাদের সন্তানরা রাজপথে নেমেছিল। আর সেখানেও মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ হয়তো নেই, যে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী ওই দেশের সাধারণ মানুষের ঘাতক।’
গুমের শিকার মাইকেল চাকমা বলেন, ‘আমাকে তুলে নেওয়ার পর আমার পরিবার, মানবাধিকার কর্মীসহ অনেকে আমাকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেছে। একপর্যায়ে আমার পরিবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। আমার বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে মারা যান। তারা (পরিবার) একসময় আমার শেষকৃত্য করে নেয়। একটা পরিবার কতটুকু আশাহীন হলে শেষকৃত্য করে নেয়।’
মন্তব্য করুন