কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৩, ০৩:৫৯ পিএম
আপডেট : ১০ আগস্ট ২০২৩, ০৫:৪০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ফরেন পলিসি থেকে

দেশে দেশে নৌঘাঁটি : কিসের প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন?

বিভিন্ন মহাদেশে নৌঘাঁটি গড়ে তুলছে চীন। ছবি : ফরেন পলিসি
বিভিন্ন মহাদেশে নৌঘাঁটি গড়ে তুলছে চীন। ছবি : ফরেন পলিসি

চীন ২০১৭ সালে তার নৌবাহিনীর জন্য আফ্রিকার জিবুতিতে একটি নৌঘাঁটি তৈরি করে। এটি ছিল দেশের বাইরে চীনের প্রথম কোনো নৌঘাঁটি। চীন সেসময় বলেছিল, আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় শান্তিরক্ষা ও মানবিক সাহায্য প্রদানে চীনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে এই ঘাঁটি। একইসাথে এটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে নয় বলেও দাবি করে চীন। কিন্তু পরবর্তীতে চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী নীতি ও বিশ্বশক্তির প্রতিযোগিতায় চীনের অবস্থান তার সামরিক উচ্চভিলাসকে উন্মুক্ত করেছে। এমন সময় প্রশ্ন উঠছে পরবর্তী নৌঘাঁটি কোথায় নির্মাণ করবে চীন?

বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং নিজের শক্তিমত্তার জানান দিতে বিভিন্ন মহাদেশে নৌঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে চীন। চীনের সাম্প্রতিক সামরিক অগ্রগতির ও বেশকিছু পদক্ষেপ থেকে এই পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিভিন্ন মহাদেশে মোট আটটি নৌঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীন। আর এজন্য চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলো ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ৪৬টি দেশে ৭৮টি বন্দরে ১২৩টি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। আর এসব প্রকল্পে ২৯.৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে চীন।

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এসব প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ শেষ করেছে চীন।

বিশ্লেষণের দেখানো হয়েছে, চীনা অর্থায়নে নির্মিত পোতাশ্রয় এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগুলো যে কোনো সময়ে চীন তার সামরিক কাজে ব্যবহার করতে পারবে। চীনা আইন অনুসারে এসব বেসামরিক বন্দরগুলো বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োজনের সময় চীনা নৌবাহিনীকে লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করবে। এসব প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ যত বড় হবে সেখানে বেইজিং তত বেশি সুবিধা চাইবে।

মার্কিন গবেষণা সংস্থা এইডডেটার এক প্রতিবেদনে আগামী দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে চীনা নৌঘাঁটি স্থাপনের জন্য সম্ভাব্য আটটি স্থানকে হাইলাইট করা হয়েছে। স্থানগুলো হলো-শ্রীলংকার হাম্বানটোটা, নিরক্ষীয় গিনির বাটা, পাকিস্তানের গোয়াদর, ক্যামেরুনের ক্রিবি, কম্বোডিয়ার রিম, ভানুয়াতুর লুগানভিল, মোজাম্বিকের নাকালা ও মৌরিতানিয়ার নোয়াকচট।

এইডডেটার গবেষকরা দাবি করেছেন, নৌঘাঁটি গড়ে তোলার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিদেশি নৌঘাঁটির উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে চীন। এটি চীনের সমুদ্র বাণিজ্যের পথগুলোকে নিরাপত্তা দেবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে শক্তিশালী করবে।

নৌঘাঁটি স্থাপনে বেইজিংয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দেওয়া। যেমনটি চেষ্টা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং তথাকথিত কোয়াড জোট ভারত মহাসাগরে চীনকে চাপে ফেলে। চীনের সম্ভাব্য এই আট নৌঘাঁটির অর্ধেকেরও বেশি প্রকৃতপক্ষে ইন্দো-প্যাসিফিকভিত্তিক। আফ্রিকার আটলান্টিক প্রান্তে বন্দরসহ চীনা বিনিয়োগ অনেক বেশি। এই অঞ্চলে চীনা কার্যক্রম অনেক বেশি সক্রিয়। এখানে চীন তার ভূ-রাজনৈতিক মনোযোগ বৃদ্ধি করেছে।

আমেরিকাকে প্রতিহত করার জন্য মৌরিতানিয়া থেকে পশ্চিম আফ্রিকার দক্ষিণ দিকে গিনি উপসাগর হয়ে ক্যামেরুন, অ্যাঙ্গোলা এবং গ্যাবন পর্যন্ত বন্দর নির্মাণ করছে চীন।

নির্দিষ্ট আটটি জায়গাকে কেন বেঁছে নিয়েছে চীন :

বিভিন্ন মহাদেশে চীনের নৌঘাঁটি। ছবি : ফরেন পলিসি

হাম্বানটোটা, শ্রীলঙ্কা :

২০১৭ সালে ৯৯ বছরের জন্য হাম্বানটোটা বন্দর ইজারা নেয় চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। চীন এই বন্দরে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে। যা এককভাবে কোনো বিদেশি বন্দরে চীনের সর্বোচ্চ খরচ। শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দরকে চীনের ভবিষ্যত পরিকল্পনার একটি অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে দেখা হয়। এখান থেকেই চীন ভারত মহাসাগরে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে।

বাটা, নিরক্ষীয় গিনি :

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনির এই বন্দর শহরটিতে চীনা নৌঘাঁটি স্থাপনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর। এখান থেকে পশ্চিম আটলান্টিকে চীন তার সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায়। এই ঘাঁটি আমেরিকা মহাদেশের খুব কাছে হওয়ায় এটি চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তার ও চীনা বাণিজ্যিক পথকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই নৌঘাঁটি চীনের জন্য জরুরি।

গোয়াদর, পাকিস্তান :

চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক উভয় ধরনের সুসম্পর্ক রয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের প্রধান অংশীদার পাকিস্তান। পাকিস্তানের নৌবাহিনী চীনা অস্ত্রের বৃহত্তম বিদেশি ক্রেতা এবং পাকিস্তানের নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণের কাজ করছে চীন। চীনা যুদ্ধজাহাজগুলো ইতোমধ্যেই পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরে অবস্থান করছে। পাকিস্তান চীনা নকশাকৃত আধুনিক যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিন পরিচালনা করছে।

গোয়াদর বন্দর পাকিস্তানের সুদূর পশ্চিমে অবস্থিত এবং কৌশলগতভাবে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি হরমুজ প্রণালিকে সুরক্ষা প্রদান করে। চীন-পাকিস্তানের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে গোয়াদর বন্দর একটি বড় উপাদান। এখান থেকে চীন এশিয়ার একটি বিশাল অংশের ওপর তার প্রভাব বজায় রাখতে পারে।

ক্রিবি, ক্যামেরুন :

ক্যামেরুনের ক্রিবি বন্দরটিতে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। এখান থেকে মধ্য আটলান্টিকে চীন তার বাণিজ্যিক ও সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর ওপর চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে এই বন্দর চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

রেম, কম্বোডিয়া :

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম কম্বোডিয়ানদের কাছে জনপ্রিয়, প্রধানমন্ত্রী হুন সেন বেইজিংয়ের দীর্ঘদিনের মিত্র। কম্বোডিয়ার অভিজাতরা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে ভালো কাজ করেছেন এবং চীনের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ভারত মহাসাগর থেকে দক্ষিণ চীন সাগরের প্রবেশমুখে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াডকে মোকাবিলায় এই বন্দর চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লুগানভিল, ভানুয়াতু :

ভানুয়াতুর এসপিরিতু সান্টো দ্বীপের পোর্ট লুগানভিলে অর্থায়ন করেছে চীন। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে নিজের সামরিক অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করতে ছোট্ট এই দ্বীপ দেশের বন্দরে চীনের সামরিক ঘাঁটির সম্ভাবনা দেখছেন গবেষকরা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থিত দ্বীপটি প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর সবচেয়ে বড় নৌঘাঁটি ছিল। মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজগুলো মেরামতের একটি আবাসস্থল ছিল এটি।

নাকালা, মোজাম্বিক :

যদিও মোজাম্বিকের নাকালা বন্দরে চীনের বিনিয়োগ খুব বেশি নয় তবুও এখানের অভিজাত এবং সাধারণ জনগণের কাছে চীন অনেক জনপ্রিয়। তাই চীনে এখানে নৌঘাঁটি গড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

নোয়াকচট, মৌরিতানিয়া :

পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটি উল্লেখযোগ্যভাবে ইউরোপের কাছাকাছি এবং জিব্রাল্টার প্রণালির মতো চোকপয়েন্টগুলোর- কাছাকাছি হওয়ায় এখানে চীন তার উপস্থিতি জরুরি বলে মনে করে।

ওয়াইল্ড কার্ড : রাশিয়া?

যদিও চীনের বিনিয়োগগুলো বেশিরভাগই উন্নয়নশীল দেশে করা হয়েছে তবুও তারা উন্নত বিশ্বেও একটি ঘাঁটির জন্য চেষ্টা করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে চীন একাধিক রাশিয়ান নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে পারে বা রুশ নৌঘাঁটিগুলোকে রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে ব্যবহার করতে পারে। চীনা স্পষ্টভাবেই পশ্চিমাবিরোধী একটি উত্থান চায়। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপকে একটি কমন হুমকি হিসেবে দেখিয়ে চীন রাশিয়ান নেতৃত্বকে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে রাজি করাতে পারে।

মূল : আলেকজান্ডার উলিশেং ঝাং (Alexander Wooley, Sheng Zhang)

ফরেন পলিসি থেকে ভাষান্তর - মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধাসহ চাকরি দিচ্ছে অ্যাপেক্স

কতজন আমেরিকান ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চায়

ঘুষ না দেওয়ায় জামায়াত নেতাদের ওপর ক্ষেপলেন কর্মকর্তা

ইরানি নেতাদের হত্যার মিশনে ইসরায়েলের ‘এআই সেনা’

তিস্তার শুষ্কতা ও ধরলার মরুকরণ : উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ বাস্তবতা

ঢাকায় ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস 

৭ কারণে ইরানকে হারানো সম্ভব না

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত থেকে যেভাবে রক্ষা পায় বাংলাদেশি বিমান (ভিডিও)

ঘুমের মধ্যে শরীরে ঝাঁকুনি, অশুভ লক্ষণ নয়তো?

মালয়েশিয়ায় বেতন বন্ধ ২৮৩ বাংলাদেশি কর্মীর

১০

১৮ জুন : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১১

ইসরায়েলে ২০ মিনিটে ৩০ ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত

১২

যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন ইরানের সুপ্রিম লিডার

১৩

বুধবার ঢাকার যেসব এলাকায় মার্কেট বন্ধ

১৪

১৮ জুন : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৫

দুপুরের মধ্যে ঢাকাসহ ১৭ জেলায় হতে পারে ঝড়

১৬

ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বন্ধ ঘোষণা

১৭

ইসরায়েলের আকাশসীমা ‘সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে’ নেওয়ার দাবি ইরানের

১৮

আমরা কোনো দয়া দেখাব না : খামেনি

১৯

বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল তেহরান

২০
X