ডিভাইস জালিয়াতি করে আটক ১০৮ জন
রংপুর ব্যুরো
ডিভাইস জালিয়াতির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা। গতকাল শুক্রবার রংপুর, বরিশাল ও সিলেট—এই তিন বিভাগের পরীক্ষা হয়। এর মধ্যে রংপুর বিভাগের ৬টি উপজেলায় নিয়োগ পরীক্ষায় ব্যাপক জালিয়াতি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব উপজেলার বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে শিক্ষক-পরীক্ষার্থী ও ডিভাইস জালিয়াতি চক্রের ১০৮ জনকে আটক করেছে। তাদের কাছ থেকে বিশেষ ধরনের ব্লুটুথ ডিভাইস, মোবাইল ফোন ও জালিয়াতির চুক্তিপত্র জব্দ করা হয়েছে।
পুলিশ ও র্যাব জানায়, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে রংপুরে ১৯ জন, গাইবান্ধায় ৩৫ জন, দিনাজপুরে ১৮ জন, কুড়িগ্রামে ১২ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ৭ জন, লালমনিরহাটে ১০ জন এবং পঞ্চগড়ে ৭ জন রয়েছেন।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় ডিভাইস ব্যবহার করে পরীক্ষার্থীর প্রশ্নপত্রের উত্তর প্রদানের চুক্তি করে একটি চক্র। চুক্তি অনুযায়ী তাদের ডিভাইস সরবরাহ করা হয়েছিল। গোপন সংবাদ পেয়ে পরীক্ষার আগে বৃহস্পতিবার রাতে ও পরীক্ষা শুরুর আগে গতকাল সকালে রংপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৯ জনকে আটক করা হয়েছে।
পুলিশ কমিশনার জানান, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন রংপুরের পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, ১১ জন পরীক্ষার্থী এবং পাঁচজন ডিভাইস জালিয়াতি সিন্ডিকেটের সদস্য। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে আটজন নারী রয়েছেন, যাদের পরীক্ষা শুরুর আগেই পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে ডিভাইসসহ আটক করা হয়।
তিনি বলেন, গোয়েন্দা বিভাগ ডিভাইস জালিয়াতি চক্রটিকে পরীক্ষার আগের রাতে, সকালে ও পরীক্ষা শুরুর আগেই কেন্দ্র থেকে আটক করে। এ কারণে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে পারেনি চক্রটি। এ ঘটনায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে ১১টি ডিভাইস, ৮০টি ফোন ও পরীক্ষার প্রবেশপত্র জব্দ করা হয়।
কালবেলার গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও মোবাইলের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে পরীক্ষা দেওয়ার মূলহোতা পাঁচজনসহ ৩৫ জনকে আটক করেছে র্যাব-১৩। গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গাইবান্ধা র্যাব ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১৩ অধিনায়ক আরাফাত ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানতে পারে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও মোবাইলের মাধ্যমে অসৎ উপায় অবলম্বন করে গাইবান্ধা জেলা শহরের বিভিন্ন কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছেন। পরীক্ষা শুরুর আগেই সন্দেহজনক কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান নেয় র্যাব। পরীক্ষা চলাকালে বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনে ও ভেতর থেকে অভিযান চালিয়ে মূলহোতা পাঁচজনসহ ৩৫ জনকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে ডিভাইস সরবরাহের হোতা মারুফ, মুন্না, সোহেল, নজরুল ও সোহাগ রয়েছে।
আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস, মোবাইল ফোন, ২৪টি মাস্টার কার্ড, ২০টি ব্লুটুথ, ১৭টি মোবাইল, ব্যাংক চেক ও স্ট্যাম্প পাওয়া গেছে।
দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে পরীক্ষায় প্রক্সি ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার এবং অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে ১৮ জনকে আটক ও ১৮ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আটক ১৮ জনের মধ্যে ৯ জন নারী ও ৯ জন পুরুষ। তাদের কাছ থেকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস সংযুক্ত মাস্টার কার্ড, ব্লুটুথ ডিভাইস ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
গতকাল এ তথ্য জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম ও কোতোয়ালি থানার ওসি মো. ফরিদ হোসেন।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম জানান, দিনাজপুর জেলায় ৫৪টি কেন্দ্রে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৩৮ হাজার ৯ জন। অনুপস্থিত রয়েছেন ৯ হাজার ৬৩৪ জন। পরীক্ষায় প্রক্সি ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার এবং অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে ১৮ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
কোতোয়ালি থানার ওসি মো. ফরিদ হোসেন জানান, প্রক্সি ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহারের দায়ে ১৮ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা আইনে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কুড়িগ্রামে বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রক্সি ও ইলেকট্রিক ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতি করে পরীক্ষা দেওয়ার অভিযোগে ১২ পরীক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩ পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী।
ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, ঠাকুরগাঁওয়ে বিভিন্ন কেন্দ্র ৭ চাকরিপ্রার্থীকে আটক ও তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সদর থানার ওসি মো. ফিরোজ কবির বলেন, সকালে পরীক্ষা চলাকালীন আটক পরীক্ষার্থীরা অভিনব কায়দায় আধুনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে বাইরে সরবরাহ করে। এরপর বাইরে থেকে উত্তর সরবরাহের মাধ্যমে তারা পরীক্ষা দেয়। অসদুপায় অবলম্বন করায় আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, পঞ্চগড়ে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার ও প্রক্সি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অভিযোগে ৭ জনকে আটক করেছে পঞ্চগড় সদর থানা পুলিশ। তাদের মধ্যে পরীক্ষায় কানের মধ্যে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করার ৫ জন, মোবাইল ব্যবহার করার অপরাধে ১ জন ও প্রক্সি পরীক্ষা দেওয়ার অপরাধে ১ জনকে আটক করা হয়।
পঞ্চগড় সদর থানার ওসি প্রদীপ কুমার রায় বলেন, এ ঘটনায় আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করছেন।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, লালমনিরহাট শহরের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ১০ নারীসহ ১৩ জন পরীক্ষার্থী আটক করেছে সদর থানা পুলিশ। তাদের মধ্যে এক নারী পরীক্ষার্থী ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এবং এক নারীর দেড় মাসের সন্তান রয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন কুমার চৌধুরী জানান, পরীক্ষা কেন্দ্রে অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে আটক পরীক্ষার্থীদের নামে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
গতকাল সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত আবেদনকারীরা নিজ নিজ জেলায় পরীক্ষায় অংশ নেন। প্রথম পর্বে রংপুর, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের ১৮টি জেলার ৫৩৫টি কেন্দ্রে এ লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্বের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ৬০ হাজার ৬৯৭। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ওই তিন বিভাগের সরকারি প্রাথমিকে শূন্য পদ রয়েছে ২ হাজার ৭৭২টি। সেই হিসাবে প্রতি পদের বিপরীতে লড়বেন ১৩০ জন।
০৯ ডিসেম্বর, ২০২৩