কেন্দ্র বনাম ঢাবি ছাত্রলীগের বিভেদে বারবার সংঘাত
কেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির শীর্ষ নেতাদের বিভেদের জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বারবার সংঘাতে জড়াচ্ছেন ছাত্রলীগ কর্মীরা। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করছে না বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করছেন ঢাবি শাখার নেতারা। এ নিয়ে কর্মীদের মধ্যেও বিভাজন তৈরি হওয়ায় প্রায়ই ঘটছে হাতাহাতিসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। গত বৃহস্পতিবার জগন্নাথ হলে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনাও কেন্দ্র বনাম ঢাবি নেতাদের দ্বন্দ্বের ফল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর থেকেই নানা বিষয়ে ঢাবি নেতাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন ছাত্রলীগের শীর্ষ পদধারীরা। এর মধ্যে গত বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত ছাত্রসমাবেশে ঢাবির নেতাদের বক্তৃতা দিতে না দেওয়ায় তাদের এই মনোমালিন্য প্রকাশ্যে আসে। এ ছাড়া অধিভুক্ত সাত কলেজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে টানাটানি এবং ঢাবি ছাত্রলীগের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই রেওয়াজের বাইরে গিয়ে কেন্দ্রের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ইচ্ছামতো পদায়নসহ বেশকিছু বিষয় নিয়ে বাগযুদ্ধে জড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ও ঢাবি ছাত্রলীগ।
সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে জগন্নাথ হলের খেলার মাঠে আয়োজিত কনসার্টে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের সঙ্গে হল কমিটির পদপ্রত্যাশী ও শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের অনুসারী গণেশ ঘোষের ধাক্কা লাগে। এ ঘটনার পর গণেশ দুঃখ প্রকাশ করে সৈকতের কাছে ক্ষমা চান। তবে কেন্দ্রীয় ও ঢাবির নেতারা সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর রাত দেড়টার দিকে ইনান ও সৈকতের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। রাত ৪টা পর্যন্ত দফায় দফায় চলে এ সংঘর্ষ।
আগের রাতের এ ঘটনা নিয়ে পরদিন (শুক্রবার) সৈকতের অনুসারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ইনানের কাছে বিচার দিতে গেলে আবার সংঘর্ষে জড়ায় দুই গ্রুপ। সেদিন রাতে আবারও জগন্নাথ হলে দুপক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। পরে হলের প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্রলীগ নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
কয়েক দফায় ঘটে যাওয়া এই সংঘর্ষে তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারীদের মধ্যে আহত হন অপূর্ব চক্রবর্তী, পলাশ রায় সৌরভ, স্বপন, তপন, সাগর, রুদ্র, অনন্ত, সেতু, বর্ষণ, কার্তিক কুমার, পল্লব মণ্ডল ও অর্পণ। অন্যদিকে শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের অনুসারীদের মধ্যে আহত হন গণেশ, প্রীতম সাহা, অভিষেক ভাদুড়ি, জয় দাস, অনুপ হাওলাদার, বিভাষ ঘোষ, দেবাশীষ, আনন্দ, ধ্রুব, চিন্ময়, রিদ্ধি ও অভি।
এর আগেও গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে জগন্নাথ হলেই ইনান ও সৈকতের অনুসারীদের মধ্যে মারামারি হয়। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও জগন্নাথ হল সংসদের সাবেক ভিপি উৎপল বিশ্বাসের কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।
এ ছাড়া গত বছরের ৬ জানুয়ারি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শাড়ি বণ্টন নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায় দুই গ্রুপ। এতে কেন্দ্রীয় সংসদের উপ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক তানিয়া আক্তার তাপসী আহত হন।
৬ ফেব্রুয়ারি ফজলুল হক মুসলিম হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় কমিটির সাদ্দাম হোসাইন, শেখ ইনান ও ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল ইসলাম শয়নের অনুসারীদের সম্মিলিত পক্ষ এবং ঢাবি সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ১৫ জন আহত হন।
২২ জুন সিট দখলকে কেন্দ্র করে মাস্টারদা সূর্য সেন হলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন এবং সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারীদের মধ্যে রাতভর সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের ১০ নেতাকর্মী আহত হন।
গত ২৩ জুলাই মধ্যরাতে রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী আয়েশা সিদ্দিকা রূপাকে মারধর করে কক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে হল ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাদ্দাম হোসাইনের অনুসারী আতিকা বিনতে হোসাইনের বিরুদ্ধে।
চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারিতেও মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের সূর্য সেন হল ও বিজয় একাত্তর হলের অনুসারীরা সালাম দেওয়াকে নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায়। এতে ৩ জন আহত হন। তাদের মধ্যে সূর্য সেন হল ছাত্রলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক কামরুল হাসান গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ঘটনার দিনই ছাত্রলীগের চারজনকে বহিষ্কার করা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে আক্ষেপ প্রকাশ করে ঢাবির হল পর্যায়ের একজন ছাত্রলীগ নেতা বলেন, আমরা ‘সবসময় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলি। বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগে এত বিভেদ, বিভাজন, মারামারি-কাটাকাটি, সংঘর্ষ এগুলো ছিল না। কিন্তু বর্তমানে এই সংগঠনে বারবার এ ধরনের ঘটনা দেখতে হচ্ছে। আমরা আমরাই মারামারিতে জড়াচ্ছি। আমরা নিজেরাই মিলেমিশে থাকতে পারছি না, ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারছি না। এগুলো দেখে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী শক্তি আমাদের নিয়ে মজা নেয়, যা খুবই দুঃখজনক।’
জানতে চাইলে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ‘কোনো কোনো অনুষ্ঠানে বেশি মানুষ উপস্থিত থাকলে অনেক সময় নিজেরা নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়ে যায়। ভুল বোঝাবুঝির কারণে অনেক সময় এরকম ছোটখাটো ঝামেলা হয়। এটা তো কর্মী পর্যায়ের ঝামেলা। কর্মী পর্যায়ে টুকিটাকি ভুলভ্রান্তি ঘটে। কিন্তু নেতৃত্ব পর্যায়ে কোনো বিভেদ হচ্ছে না—এ রকমটা নয়। এ ধরনের ছোটখাটো ঘটনাও যেন না ঘটে, সেদিকে আমরা নজর দিচ্ছি। সংগঠনের ঐক্য নষ্ট হয়, এমন কোনো ঘটনা কেউ ঘটালে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিই বা নেওয়ার চেষ্টা করি, ভবিষ্যতেও এটা করব।’
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কোনোরকম বিরোধ নেই বলে আমার মনে হয়। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নাম্বার ওয়ান এবং সবচেয়ে সুসংহত ইউনিট। এ ইউনিটটি অতীতের ধারা বজায় রেখে ছাত্রলীগের সব কর্মসূচিতে ভালোভাবে কাজ করবে এবং ছাত্রলীগের সব নির্দেশনা সুষ্ঠুভাবে পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ বজায় রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সংগঠনে কোনো গ্রুপিং নেই। এখানে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ। তবে নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকে। এই ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমেই অনেক সময় ছোটখাটো ঘটনা ঘটে এবং ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যে কোনো গ্রুপিংয়ের উপস্থিতির সুযোগ নেই।’
মন্তব্যের জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন ও ঢাবি মাজহারুল কবির শয়নকে বারবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪