বিগত সরকারের আমলে পুঁজিবাজারে সক্রিয় একটি গোষ্ঠী শেয়ারবাজারে কৃত্রিম ওঠানামার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। তাদের সূক্ষ্ম কারসাজির ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অসংখ্য সাধারণ বিনিয়োগকারী। এসব ঘটনায় তৎকালীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কার্যত কোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে দায়সারা তদন্ত ও নামমাত্র জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্যান্য খাতের মতোই বিএসইসিতেও আসে পরিবর্তনের হাওয়া। সংস্থাটির নতুন কমিশনের নেতৃত্বে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। তিনি দায়িত্ব নিয়েই অতীতের বড় বড় কারসাজির ঘটনা খতিয়ে দেখতে শুরু করেন। বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে শুরু করেন ব্যাপক জরিমানার কার্যক্রম। বেক্সিমকো, ওরিয়ন ফার্মা, ওরিয়ন ইনফিউশনসহ বেশকিছু প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে গৃহীত হয় নজিরবিহীন জরিমানা, যার মোট অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ৩৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এটি দেশের পুঁজিবাজার ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ জরিমানার রেকর্ড।
তবে এসব জরিমানা আদায়ের ক্ষেত্রে বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। কমিশন গত ৯ মাসে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি। আইন ও প্রক্রিয়ার মারপ্যাঁচেই এসব অর্থ সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না বলে স্বীকার করছে বিএসইসি কর্তৃপক্ষ।
নিয়ম অনুযায়ী, বিএসইসি কোনো কারসাজির ঘটনার প্রমাণ পাওয়ার পর নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে জরিমানা আদায়ের নির্দেশ দেয়। সময়সীমা পার হলে প্রতিদিনের ভিত্তিতে নতুন করে অতিরিক্ত জরিমানা ধার্য হয় এবং পরবর্তী সময়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্সের ৬৯-এর ২২ ধারায় তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া এত দীর্ঘ এবং আইনি প্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ যে, জরিমানাগুলো শেষ পর্যন্ত আদায় সম্ভব হয় না।
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম কালবেলাকে বলেন, ‘যাদের জরিমানা করা হয়, তাদের কিছু মৌলিক অধিকার থাকে। তারা ৯০ দিনের মধ্যে রিভিশন এবং ১৮০ দিনের মধ্যে রিভিউ করতে পারেন। এই সময় পর্যন্ত কমিশন অপেক্ষা করতে বাধ্য। কেউ চাইলে ওই জরিমানার ১৫ শতাংশ জমা দিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করতে পারে। কোর্ট যতদিন চূড়ান্ত রায় না দেয়, ততদিন জরিমানা আদায় করা সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি আবেদন না-ও করে, তবে নির্দিষ্ট সময় পার হলে আমরা পিডিআর অ্যাক্ট অনুযায়ী সার্টিফিকেট মামলা করি। আদালত সে ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট জারি করে অভিযুক্তকে হাজির করাতে পারেন। জরিমানা হলেই সঙ্গে সঙ্গে তা আদায় হয়ে যাবে—এমন কোনো বিধান নেই।’
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, আইনের দীর্ঘসূত্রতা এবং কঠোর প্রয়োগের অভাবে জরিমানা আদায় হচ্ছে না। ফলে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে এবং এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
বিএসইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ‘প্রথম দিকে জরিমানার ক্ষেত্রে কমিশন বেশ সক্রিয় ছিল। কিন্তু আদায়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। নির্ধারিত সময় পার হলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না, এটা খুবই হতাশাজনক।’
কাকে কত জরিমানা: জরিমানার পরিমাণের দিক থেকে বেক্সিমকো লিমিটেড সবচেয়ে আলোচিত। বেক্সিমকো লিমিটেডের চার ব্যক্তি ও পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে ৪২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি, যা বিএসইসির ইতিহাসে রেকর্ড। ইমাম বাটনের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ১ কোটি টাকা, কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির কারণে ২০ লাখ টাকা, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরন্সের শেয়ার কারসাজির ঘটনায় ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, সোনালী পেপারের তিন শেয়ারধারীকে ৬০ লাখ টাকা, বে-লিজিংয়ের শেয়ার কারসাজিতে ৪ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ১৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, হিরু ও তার পরিবারের সদস্য এবং প্রতিষ্ঠানকে ১৩৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, ফাইন ফুডসের শেয়ার কারসাজিতে জড়িতদের ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, আমিনুল-হিরু চক্রকে ১০ কোটি ১৩ লাখ টাকা, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেড, জেনারেল ইনস্যুরেন্স এবং আনোয়ার গ্যালভানাইজিং লিমিটেডের শেয়ার কারসাজির দায়ে সাত প্রতিষ্ঠান ও ১২ ব্যক্তিকে ১৩৪ কোটি টাকা, খান ব্রাদার্সের শেয়ার কারসাজিতে ৭ ব্যক্তি ও ৩ প্রতিষ্ঠানকে ৮৬ লাখ টাকা, সাকিব-হিরুদের শেয়ার কারসাজিতে ৩১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার কারসাজিতে জড়িতদের ৫৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা, হিরু-সাদিয়াকে ১৯ কোটি টাকা, সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেড ও সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার কারসাজিতে ১৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ১৯০ কোটি টাকা, জেমিনি সি ফুডের কারসাজিতে ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের কারসাজিতে রাভী হাফিজকে ১৫ কোটি টাকা এবং সাকিব-হিরুকে আরও ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা। মোট ১ হাজার ৩৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি, যা ৯ মাস পার হওয়ার পরও কোনো জরিমানা আদায় করতে পারেনি সংস্থাটি।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন: জরিমানা আদায় না হওয়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ কালবেলাকে বলেন, আগে লোক দেখানো জরিমানা করা হতো। বর্তমানে কারসাজি অনুযায়ী জরিমানা করা হয়েছে। তবে এসব জরিমানা করা যতটা সহজ, তা আদায় করা আরও অনেক কঠিন। জরিমানা আদায় হওয়ার নজির খুব কমই আছে।
একটি সিকিউরিটিজ হাউসের প্রধান নির্বাহী কালবেলাকে বলেন, জরিমানা আদায় করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের পরিবর্তন করতে হবে। কারা সার্কুলার ট্রেডিং (ব্রোকাররা নিজেদের মধ্যে এমনভাবে শেয়ারের কেনাবেচা করে যে, মনে হয় ওই শেয়ারের খুব চাহিদা রয়েছে) করে, আর কারা ফ্রন্টলাইন ট্রেডিং (বড় অর্ডারের তথ্য আগে ভাগে জেনে শেয়ার কেনা বা বেচা) করে—এই সবকিছুই তো বিএসইসির কাছে তথ্য রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সেভাবেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
মন্তব্য করুন