হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। সময় যত গড়াচ্ছে, পরিস্থিতির তত অবনতি হচ্ছে। দুদিনের এ সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের হুমকি তৈরি করেছে। সংঘাত গাজার বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে—এমন শঙ্কার মাঝেই গতকাল রোববার ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে লেবাননের ইরান-সমর্থিত শিয়াপন্থি গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। হামাসের সমর্থনে হিজবুল্লাহ এ হামলা চালানোর পর ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী লেবাননেও পাল্টা গোলাবর্ষণ করে। গত শনিবার ভোরে শুরু হওয়া সংঘর্ষে এ পর্যন্ত উভয়পক্ষের অন্তত ১১০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও কয়েক হাজার। ইসরায়েল এরই মধ্যে এ সংঘর্ষকে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করেছে। গতকাল রোববার দেশটির মন্ত্রিসভা এ ঘোষণা দিয়েছে। এর মাধ্যমে দেশটির সরকার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। অন্যদিকে, ফিলিস্তিন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, উপস্থিত এবং দখলদার সেনাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মরক্ষা করার অধিকার রয়েছে। এদিকে সাধারণ মানুষকে চলমান লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সামরিক শাখা। ইসরায়েলি বাহিনী ও হামাস যোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই অব্যাহত থাকায় আল কাসেম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু ওবেদা এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান। খবর বিবিসি, আলজাজিরা ও সিএনএনের।
খবরে বলা হয়, বেশকিছু স্থানে হামাস ও ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে চলছে সশস্ত্র লড়াই। টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, গাজা সীমান্তের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ম্যাগেনে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র বন্দুকযুদ্ধ চলছে। এ সংঘাতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ভারী ট্যাঙ্ক ব্যবহার করছে। মূলত ইসরায়েলের ভেতর থেকে হামাস যোদ্ধাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে ইসরায়েলি বাহিনী। পাশাপাশি গাজার বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করেও হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন সংঘাত শনিবার থেকে নতুন করে সারা বিশ্বের নজরে এলেও বহু বছর ধরেই অমীমাংসিত এক সংঘাতে জড়িয়ে আছে তারা। ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ফিলিস্তিনি নিহতের খবর প্রায়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জায়গা করে নেয়। তবে ফিলিস্তিনিদের হাতে ইসরায়েলি নিহত হওয়ার খবর তুলনামূলক কমই আসে। এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। ফিলিস্তিনের পাশাপাশি ইসরায়েলেও নিহতের সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৭০০ ছাড়িয়েছে। নিহতদের মধ্যে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর সদস্যও রয়েছে। অন্যদিকে, বিমান হামলা ও সম্মুখ যুদ্ধে হামাসের চারশর বেশি যোদ্ধাকে হত্যা করার দাবি করেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বিভাগ (আইডিএফ)।
গাজায় হামাসের মুখপাত্র আবদেল-লতিফ আল-কানোয়া বলেছেন, আমাদের জনগণকে রক্ষার জন্য ইসরায়েলে হামলা চলছে। হামাসের যোদ্ধারা রকেট হামলা অব্যাহত রেখেছে। ৫০ বছর আগে ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধে হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় মিশর ও সিরিয়া একযোগে ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা শুরু করেছিল। ওই যুদ্ধের পর এবার হামাসের হামলা ইসরায়েলে সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ প্রাণঘাতী হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা।
যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, সন্ত্রাসবাদের কোনো যুক্তি নেই। আমরা ইসরায়েলের সরকার ও জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। হামলায় ইসরায়েলিদের প্রাণ হারানোর জন্য সমবেদনা জানাচ্ছি।
জাতিসংঘ: জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক শান্তিদূত টর ওয়েনেসল্যান্ড বলেন, এটি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। আমি সবার কাছে আবেদন করছি, এ অবস্থা থেকে সরে আসতে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনার ভলকার টুয়ের্ক বলেন, এ আক্রমণ ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর একটি ভয়ংকর প্রভাব ফেলছে। বেসামরিক ব্যক্তিরা কখনই আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারেন না।
ইরান: দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। তার সামরিক উপদেষ্টা ইয়াহিয়া রহিম সাফাভি বলেন, ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের পাশে থাকব।
চীন: চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে শান্ত থাকতে, সংযম অবলম্বন এবং বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা এবং পরিস্থিতির আরও অবনতি এড়াতে অবিলম্বে শত্রুতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। চীনের মতে সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার মৌলিক উপায় হল দ্বিরাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়ন এবং ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
আরব লিগ: আরব লিগের প্রধান আহমেদ আবুল ঘেইট গাজায় সামরিক অভিযান দ্রুত বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। তিনি দুই পক্ষের সশস্ত্র লড়াইয়ের অবসান চেয়েছেন।
ওআইসি: অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের চলমান তীব্র লড়াইকে ‘ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসন’ হিসেবে উল্লেখ করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর বৃহত্তম জোট ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)। গতকাল এক বিবৃতিতে অবিলম্বে ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের আহ্বানও জানিয়েছে এ জোট।
জার্মানি: জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস বলেছেন, ইসরায়েল থেকে ভয়াবহ সংবাদ আমাদের কাছে এসেছে। গাজা থেকে রকেট হামলা এবং ক্রমবর্ধমান সহিংসতায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। এ হামলার নিন্দা জানিয়ে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়াচ্ছে জার্মানি।
ফ্রান্স: ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এ হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়ে ভুক্তভোগী, তাদের পরিবার এবং নিকটজনদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন।
সৌদি আরব: সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশন: ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডা লেন এক্সে দেওয়া পোস্টে লিখেছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের সন্ত্রাসী হামলায় আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা জানাই। এ ধরনের ঘৃণ্য হামলার বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করার অধিকার ইসরায়েলের আছে।