ছন্দা চক্রবর্ত্তী
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২১ জুন ২০২৫, ০৭:৪৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মাতৃত্ব সংক্রান্ত অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি

মাতৃত্ব সংক্রান্ত অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি

পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে জীবনের অস্তিত্ব চলমান। আর জীবন মানেই জীবের উৎপত্তি। এই জীবের উৎপত্তিতে জড়িয়ে রয়েছে কোটি কোটি প্রজাতির উদ্ভব, এককোষী জীব থেকে বহুকোষী প্রাণী সবাই বংশবৃদ্ধি করেই আজ এ জগতের সৃষ্টি। এ সৃষ্টি প্রক্রিয়ার আবর্তে প্রতিটি প্রজাতি তার নিজস্ব খাপ খাওয়ানোর যোগ্যতা নিয়েই অপত্য প্রজাতি সৃষ্টি করে চলেছে। সবচেয়ে সেরা সৃষ্টি মানুষ প্রজাতির ক্ষেত্রেও একই ধারাবাহিকতায় সন্তান জন্ম প্রক্রিয়া নির্ধারিত। মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু বিশ্বের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এসব সাধারণ প্রক্রিয়াগুলোর উন্নয়ন চিন্তা, গবেষণা কার্যক্রম, পর্যবেক্ষণ, পরিবেশের পরিবর্তন ইত্যাদি নানা বিষয়ের আধুনিক উদ্ভাবন তো মানুষের মঙ্গলের জন্যই। তাই মানব জন্মের শুরু থেকে তথা মাতৃজঠরে ভ্রূণ আবির্ভাবের মুহূর্ত থেকে শিশু ভ্রূণ, মা এবং মাতৃত্বের সুরক্ষা প্রয়োজন, প্রয়োজন উন্নত ব্যবস্থায় সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে নিরাপদ প্রসব। শিশু জন্মদানে যেন মাতৃ-মৃত্যুহার হয় শূন্য শতাংশ। নারীদের মাতৃত্ব-সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধার অধিকারগুলো নিশ্চিত করা গেলেই মাতৃমৃত্যু হার শূন্যতে আনা সম্ভব।

সাধারণত প্রসবের ৪২ দিনের মধ্যে কোনো মায়ের মৃত্যু হলে সেটাকে মাতৃমৃত্যু বলা হয়। বর্তমানে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু সংখ্যা ২১৬; এ হিসাবে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ জন প্রসূতি মা সন্তান জন্মদানের সময় মারা যান। বাংলাদেশে সরকারি তথ্যমতে, মারা যান প্রতিদিন ১৫ জন। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে সাধারণ জনগণের ধারণা। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মাতৃমৃত্যুর কারণের মধ্যে সাদা চোখে যা দেখা যায়, তা হলো—প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রসূতি মায়েরা বা তাদের অভিভাবকরা হাসপাতালে যোগাযোগ করতে না পারা, বাল্যবিয়ে, শিক্ষার অভাব, কুসংস্কার—এসব কারণে মায়েদের মৃত্যুহার বেশি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাসপাতালে চিকিৎসকের সংকট ও যথাযথ প্রস্তুতির অভাবেও মারা যান প্রসূতি মা। বাংলাদেশে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ১৭৬ জন করে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়। এসডিজির লক্ষ্যমতে, ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু হার ৭০ বা তার নিচে রাখতে হলে বিশেষ করে সরকারকে এ মাতৃত্ব-সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করায় গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

মাতৃমৃত্যুকে শূন্যহারে আনা একটি চ্যালেঞ্জমূলক কাজ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা বর্তমান সময়ের জন্য সবচেয়ে অগ্রগণ্য কাজের মধ্যে পড়ে। ‘আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’ বা ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’—সেই আপ্তবাক্যের শিশুকে পেতে হলে মাকে সুরক্ষা দিতে হবে সর্বাগ্রে। মায়ের গর্ভ থেকে শুরু করা পরিচর্যায় স্বামী, সংসার, সমাজ প্রতিষ্ঠান এবং সরকার প্রত্যেককে যার যার জায়গা থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। সেটি যেমন আছে স্বামীর মানসিক সাপোর্ট, সংসারের মানুষগুলোর আন্তরিক সমর্থন, সমাজের প্রসূতি পরিচর্যা ব্যবস্থা, কর্মজীবী মায়েদের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের বিধি মোতাবেক আন্তরিক সহযোগিতা ও সরকারের প্রসূতি-পরিচর্যার গৃহীত পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। নিরাপদ মাতৃত্ব হলো, মায়ের চাওয়া অনুযায়ী গর্ভধারণ, গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ প্রসব, প্রসব-পরবর্তী সেবা নিশ্চিত হওয়া। এগুলোই প্রত্যেক প্রসূতি মায়ের অধিকার, যে অধিকার খর্ব হচ্ছে বলেই আজ বাংলাদেশের মাতৃমৃত্যু হার কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

নিরাপদ মাতৃত্বের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মূলত সরকারের ওপর বর্তায়। বর্তমান সরকারের ‘মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়’র অধীনের দপ্তরগুলোর নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য নানা রকম কর্মসূচি রয়েছে। কর্মসূচিগুলোর সঠিক বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করে নিরাপদ মাতৃত্ব। বিশ্বায়নের এ যুগে মায়েদের নিরাপদ মাতৃত্বের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো মায়েদের অধিকার। যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে মাতৃত্বের সে অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। সচেতন শিক্ষিত নারীরা নিজ থেকেই মাতৃত্বকালীন সেবা গ্রহণ করেন, এজন্য নারীদের শিক্ষার মাধ্যমে সচেতন করে তুলতে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প রয়েছে। তার মধ্যে প্রসূতি মায়ের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে কিশোরীদের পুষ্টিবিষয়ক পরামর্শ ও সেবা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারীদের পাঁচ ডোজ টিডি এবং শিশুদের ইপিআইভুক্ত টিকাগুলো প্রদান করে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, সাধারণত প্রসূতি মায়েদের মৃত্যু হয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। তাই মায়েদের পুষ্টি নিশ্চিত করার প্রকল্পে কিশোরীদের মধ্যে ফলিক অ্যাসিড বিতরণ কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করা জরুরি।

বাংলাদেশে সব কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। নারীরা পারিবারিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি চাকরি করে একই সঙ্গে গর্ভধারণ করে থাকে। উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা সচেতন; তাই তারা নিজেদের উদ্যোগে নিজেরা সন্তান জন্মদান পর্যায়ে সজাগ থাকেন। কিন্তু এ দেশে প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক প্রতিকূল পরিবেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের সন্তান জন্মদানের মতো কঠিন অবস্থার মধ্যেও যেতে হয়। বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে তাদের মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা ও বিভিন্ন কল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা থাকলেও তাদের সেই অধিকার গ্রহণ করার সুযোগ পায় না। বাংলাদেশ শ্রম আইনে আছে, প্রত্যেক নারী শ্রমিকের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ও প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা একটা বিশেষ অধিকার, তাই নারী শ্রমিকরা যাতে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সরকারের সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

নারীদের মাতৃত্ব-সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে দরিদ্র অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের গর্ভকালীন ভাতা পাওয়াও একটি অধিকার হিসেবে চালু রয়েছে, গত সরকারের কালে চালু হওয়া এ সেবা কিছুদিন বন্ধ থাকলেও এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এ ভাতা চালু করেছে। অর্থাভাবে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ যাতে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, তাই বাংলাদেশ সরকার মাসিক ৮০০ টাকা হারে প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর করে চারবার বা ২৪ মাস ভাতা প্রদান করে থাকে। পারিবারিক মাসিক আয় ৮০০০ টাকার কম হলেই এ সুবিধা প্রাপ্য হয়। এর জন্য আবেদন করে ভাতা তালিকায় নথিভুক্ত হতে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রত্যেক নারী শ্রমিক এ সুবিধা নানা বাধার মুখে বা অপকৌশলের দৌরাত্ম্যে, ভাতা পাওয়া সহজ হয় না। সরকারকে এ বিষয়গুলোতে বাস্তবায়ন যোগ্য তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন।

প্রত্যেক প্রসূতি মাকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে প্রথমত সরকারকে বাজেট, জনবল, প্রশিক্ষিত নার্স বাড়াতে হবে। মাতৃত্বকালীন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত ও অধিকার আদায় করা জন্য প্রত্যেক প্রসূতি মাকে সরকারি উদ্যোগে রেজিস্ট্রিভুক্ত করে নিতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে প্রত্যেক প্রসূতিকে প্রসবকালীন সময়ের আগে ও পরে প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা প্রদান কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে। সব প্রসূতিকে হাসপাতালে নিয়ে আসার এবং হাসপাতালেই প্রসবের ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়ি থেকে হাসপাতাল অবধি পৌঁছানোর জন্য ভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স বা গাড়ি প্রস্তুত কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। উপজেলা, জেলা হাসপাতালে রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকলে তা ঠিক করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সরকারিভাবে নিশ্চিত রাখতে হবে। রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি প্রতিরোধ করা গেলে নিরাপদ মাতৃত্বের অধিকার অনেকটাই নিশ্চিত করা যাবে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। যেহেতু এসব মাতৃত্ব-সংক্রান্ত সুযোগ ও নিরাপদ প্রসব প্রত্যেক প্রসূতি মায়ের অধিকার, তাই সরকারকে বিনামূল্যে এসব সেবা প্রদান করে দেশকে এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। মাতৃসেবা নিশ্চিত না হলে মাতৃমৃত্যুর হারও কমানো সম্ভব নয়। তবে সরকারের পরিকল্পনার আন্তরিক বাস্তবায়ন মাতৃত্ব-সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পৌঁছানো পর্যন্ত অর্জন সম্ভব।

লেখক: প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাবেক সিইসির সঙ্গে মব জাস্টিসের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

মিরাজের অধিনায়কত্বে বাংলাদেশের ওয়ানডে স্কোয়াড ঘোষণা

রাস্তার ধারে পড়ে ছিল যুবকের গলা কাটা মরদেহ

রাজবাড়ীতে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা

ইসরায়েলে আরেক দফায় ইরানের হামলা

যশোরে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের ভুয়া বিজ্ঞপ্তি, বোর্ডের সতর্কবার্তা

মার্কিন হামলায় ইরানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে : ট্রাম্প

ইরানের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে যারা

ডিম সেদ্ধ না ভাজা, কোনটি বেশি স্বাস্থ্যকর?

আর্জেন্টাইন বিস্ময়বালকের দুর্দান্ত ফ্রি-কিকে আল-আইনের বিপক্ষে সিটির বিশাল জয়

১০

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘ফিডিং কর্মসূচি’ শিগগিরই শুরু

১১

বার্সা নামেই ক্ষোভ, বিলবাওয়ে মুছে ফেলা হলো নিকোর মুখ

১২

ট্রাম্পকে থামাতে নোবেল দেওয়া হোক : হনসল মেহতা

১৩

ইরানের হামলায় ইসরায়েলের হার্মেস-৯০০ ড্রোন ভূপাতিত

১৪

১০ জন নিয়েও ক্লাব বিশ্বকাপে রিয়ালের দারুণ জয়

১৫

ঝড়বৃষ্টিতে এসি চালানো কি নিরাপদ? হতে পারে যেসব বিপদ

১৬

ইরানে মার্কিন হামলার পর মুখ খুললেন খামেনি

১৭

সরকারি খাল ভরাট করে বাইপাস সড়ক

১৮

সবসময় নিয়ম মেনে কর দিয়ে এসেছি: নুসরাত ইমরোজ তিশা

১৯

পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণ কী, যেসব খাবার শুক্রাণু বাড়ায়

২০
X