

প্রচলিত একটি প্রবচন, ‘মশা মারতে কামান দাগানো!’ এর নানান রকমের দোতনা রয়েছে। এক. অক্ষমের আস্ফালন। দুই. মানুষকে বোকা বানানোর কৌশল। যে কাজটি হাসিনা সরকার নানাভাবে করার চেষ্টা করেছে। আবার মশা নিয়েও হরেক কিসিমের মশকরাও করেছে বিগত সরকার। মশা মোকাবিলার নামে মাছ-পাখি, কোনো কিছুই বাকি রাখা হয়নি। এমনকি শাব্দিক অর্থেই কামানের মতো ফগার মেশিন ব্যবহার করেছে। বলা হয়, ওষুধে না মরলেও ফগার মেশিনের বিকট শব্দে মশককুল ক্ষণিকের জন্য হলেও বয়রা হয়ে যেত। মহাসমারোহে এ ফগার উদ্বোধনও করা হয়েছে এবং এর মডেল হয়েছেন মেয়র হিসেবে ব্যর্থতার মনুমেন্ট খোদ সাঈদ খোকন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সন্তান যে কোন মাত্রায় আকাম্মা হতে পারে, তার চিরকালের পোস্টার বয় হয়ে থাকবেন আলুমার্কা সাবেক এই মেয়র।
বলাবাহুল্য, বিগত সরকারের কোনো আয়োজনেই মশা মরেনি। তবে দুটি কাজ হয়েছে। এক. মশক নিধনের নামে বখেদমতে হুজুরে আলারা জনগণের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা মেরে দিয়েছেন। দুই. মশার কয়েল ব্যবসায়ীরা সমানে পাবলিকের পকেট কেটেছেন। এই ধারায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও পিছিয়ে ছিল না। অবশ্য এরা কোনোকালেই পিছিয়ে থাকে না। তবে এজন্য ক্ষমতাসীনদের নজরানা তো দিতেই হয়েছে। এই তরিকা সে-যুগ বা এ-যুগ বলে কোনো কথা নেই, সর্বকালেরই। কিন্তু কোনোকালেই মশা মরেনি। ফলে এক ধরনের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে শেখ হাসিনা ও মশা দূর হওয়ার নয়। কিন্তু জনতার প্রবল চাপে শেখ হাসিনা দূর হয়েছেন। তবে এটি আকাশ ভেঙে পড়ার মতো তেমন কিছু নয়। কারণ, যুগে যুগে এমনটাই হয়ে আসছে। আর উৎখাত ও হত্যার মাধ্যম শুধু সরকার নয়, শাসনব্যবস্থাই পাল্টে দেওয়া হয়েছে নানান দেশে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয় অক্টোবর বিপ্লবকে। ১৯১৮ সালে সপরিবারে হত্যা করা হয় রাশিয়ার শেষ সম্রাট জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে। গুলি করে এবং বেয়নেট চার্জ করে সম্রাটের স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করা হয়। এমনকি গৃহকর্মীদের রেহাই দেয়নি বলশেভিকরা। এ হত্যাকাণ্ড চালানো হয় ইয়েকাতারিনবার্গের অর্থোডক্স গির্জায়। যে গির্জাকে বলা হয় ‘চার্চ অন দ্য ব্লাড’। হত্যার পর মৃতদেহগুলো শহরের বাইরে ফেলে দেওয়া হয়। একই রকম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে। তবে লাশগুলো পড়েছিল সিঁড়ি ও মেঝেতে। পরে যথাযথ নিয়মে দাফন করা হয়েছে।
উৎখাত ও হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে দুটি কথা প্রচলিত আছে। এক. ক্ষমতা চিরকালের নয়। দুই. বেশি দিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাইলে নিদারুণভাবে বিদায় নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ড মামুলি বিষয়। এ হিসেবে শেখ হাসিনার কপাল ভালো বলেই মনে করেন অনেকে। বলা হয় সামগ্রিক পরিস্থিতি তার জীবন রক্ষার অনুকূলে ছিল। পিতার মতো শেখ হাসিনা লাশ হননি। বরং ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ প্রবচন ধারণ করে জীবন নিয়ে উড়াল দিতে পেরেছেন, পেয়েছেন সেফ এক্সিট। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত জটিল পরিস্থিতি যেন আরও জটিল না হয় এবং সম্ভাব্য সংঘাত এড়ানো যায়—তাই সমঝোতার মাধ্যমে সেফ এক্সিটের দিকে আগানো হয়। আর এর মাধ্যমে সাধারণত দুপক্ষই লাভজনক অবস্থানে থাকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের মন্তব্য, ‘চলে গেলে সেও নিরাপদ থাকল, আমরাও ঝামেলামুক্ত থাকলাম। ব্যাপারটা এরকম যে, একজন দুর্বৃত্ত, একজন গণশত্রু পালালেন, তাকে সাহায্য করা হলো পালাতে। যারা এ সাহায্য করলেন তারাও একই গোয়ালের গরু।’
একটু খেয়াল করলেই অনেকের মননে আসবে, শেখ হাসিনার সেফ এক্সিটের পর দেশ থেকে অনেক উপদ্রবের মতো মশাও অনেকটা বিদায় নিয়েছে। এদিকে মশার ব্যাপারে আমার নিজের কিছুটা হলেও স্বস্তির অভিজ্ঞতা আছে রাজধানী ঢাকা ও বিভাগীয় শহর বরিশালে। এ প্রসঙ্গে ধরা যাক, যেহেতু রাজধানীতে হেভিওয়েট হুজুররা থাকেন, সেহেতু মশা না মেরে দুই আনা-এক আনা, তথা পাতি হুজুরদের আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু বরিশালে তো সেরকম বিশাল মাপের কোনো হুজুর থাকেন না। আগিলা জমানার দানবসম হুজুরে আলাদের অনেকে পলাতক, কারও সম্বল এখন থালা-বাটি-কম্বল। এ অবস্থায় বরিশালে একমাত্র বখেদমতে হুজুরে আলা হচ্ছেন বিভাগীয় কমিশনার মো. রায়হান কাওছার এবং তিনি বরিশালের সিটি করপোরেশনের প্রশাসকেরও দায়িত্বে আছেন। মানে বিভাগের প্রধান কোতোয়ালের পাশাপাশি তিনি নগর পিতাও। নগরপ্রধান হিসেবে সাধারণের দৃষ্টিতে তার প্রধান কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে মশা মারা ও আবর্জনা পরিষ্কার করা। তবে শুধু এটি নয়, তিনি আরও অনেক কাজ করেছেন, যা বরিশালে অবস্থান করে সরকারি কর্মকর্তার পক্ষে করা প্রায় অসম্ভব। এ অসম্ভবকে সম্ভব করতে গিয়ে তাকে রাজনৈতিক চাপও মোকাবিলা করতে হয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। শোনা কথা, বিএনপির কেউ তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে গেলে তিনি নাকি বলেন, ‘আমাকে ফাঁপর দিয়ে লাভ নাই, তারেক রহমানের সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়।’ তবে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে কথা হওয়ার আওয়াজ দেন কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি।
সম্প্রতিককালে নানান প্রসঙ্গ নিয়ে ভাবনার মধ্যে দৈনিক কালবেলায় মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো একটি খবর চোখে পড়ল ১৩ অক্টোবর। আইএসপিআরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির সূত্রে খবরটি হচ্ছে, ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারের আওতায় ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান-২০২৫’-এর অংশ হিসেবে বিমান নজরদারি মিশন পরিচালিত করছে, যা গত ৪ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলে। এ টহল অভিযানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারগুলোতে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সার্চলাইট (নাইট সান) সংযুক্ত করা হয়েছিল, যা অন্ধকারেও কাজ করা এবং সন্ধ্যার পর মাছ ধরার নৌযানগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সহায়তা করে। আইএসপিআর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানিয়েছে, এ মিশনে বিমানবাহিনীর ত্রুরা নাইট ভিশন গগলস ব্যবহার করেছেন, যা সম্পূর্ণ অন্ধকারে কার্যকর নজরদারি নিশ্চিত করে এবং নিষিদ্ধ মাছ ধরার কার্যক্রম শনাক্ত করতে সহায়তা করে। মিশনগুলো আকাশ হতে ভূমিতে যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে, যা মাঠ পর্যায়ের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সমন্বয় নিশ্চিত করে। উল্লিখিত অঞ্চল ছাড়াও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একাধিক ঘাঁটি থেকে কুতুবদিয়া, বরিশাল এবং ভোলা অঞ্চলেও এ বিমান নজরদারি মিশন পরিচালনা করে। আইএসপিআর জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী আকাশের অভিভাবক হিসেবে এবং দেশের পরিবেশ ও সম্পদ রক্ষায় দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ আছে ও থাকবে। ১২ অক্টোবর দুটি হেলিকপ্টার দিয়ে টহল কার্যক্রম শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টায় মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার মুন্সীগঞ্জ সদর, লৌহজং, শিবচর, কালকিনি, জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ উপজেলাগুলোর নদীতে হেলিকপ্টারে নজরদারি করা হয়। একই সময়ে অন্য আরেকটি হেলিকপ্টারে খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরা জেলার শরণখোলা থেকে শায়ামনগর এবং সুন্দরবন ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে টহল দেয় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার।
মা ইলিশ রক্ষায় এ খবরে মনজগতে নানান ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এক. মা ইলিশ রক্ষায়ই যদি বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হয়, তাহলে মৎস্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর এবং জেলা থেকে উপজেলা পর্যন্ত মৎস্য অফিস ও এত বড় লটবহর আছে কোন কামে? দুই. ধরা যাক মন্ত্রণালয় থেকে উপজেলা পর্যন্ত সরকারি মৎস্য বিভাগের লোকেরা মিনি মাছের মতো নিরীহ। তবে অনেকের দৃষ্টিতে তাদের প্রবণতা কিন্তু বোয়াল মাছের! তারা টাকা গেলার জন্য সবসময় হাঁ করে থাকেন এবং এ কাজ করার জন্য নানান ফন্দিফিকির বের করতে বেশ পটু। এমনকি শামুক রক্ষার নামেও প্রকল্প গ্রহণে তাদের রয়েছে ক্ষুরধার মেধা। ভাবচক্কর দেখে বিভ্রম হতে পারে, তারা শামুকের মতোই নিরীহ ও ধীরগতির। ফলে মা ইলিশ রক্ষা তাদের কম্ম নয়। তিন. মৎস্য বিভাগের লোকজনদের এ অবস্থাকে বাস্তব হিসেবে ধরে নিলেও মহাপরাক্রমশালী জেলা প্রশাসকরা তো আছেন! তাদের ক্ষমতার আওতা কিন্তু বিশাল। ডিসিরা তো ব্রিটিশ সৃষ্ট প্রশাসনিক লিগ্যাসি। এর ওপর তাদের ক্ষমতা ও দাপট বেড়েছে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, প্রতিটি সরকারের আমলেই। এমনকি আঠারোর রাতের ভোটের পর সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন তো একপ্রকার দানব হয়ে উঠেছিল। আর ডিসিরা হয়ে উঠেছিলেন অনেকটা ব্রিটিশ আমলের জমিদারদের মতো। প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ আমলে জমিদারদের জন্য ‘সাত খুন মাফ’ বলে একটি কথা প্রচলিত ছিল। আর হাসিনা আমলের ডিসিদের জন্য প্রায় সবকিছুই মাফ ছিল—এমন পারসেপশন সৃষ্টি হয়। ফলে ডিসিরা এতই বেপরোয়া ছিল যে, অনেক ডিসি প্রকাশ্যে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি ইউএনও মহল কোনো কোনো সময় এমপিদের দিকে এমনভাবে তাকাতেন, ‘তুমি কে হে বাপু!’
এতেও তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা ছিল না। বিপদ হচ্ছে, ডিসিদের মান নিম্নমুখী হওয়ায়। অনেক ডিসির মান তো একেবারে তলানিতে। আবার কোনো কোনো ডিসির তো নানান কেচ্ছাকাহিনি প্রকাশ পাচ্ছে বিভিন্ন সময়। অবশ্য অনেক ডিসির লীলাকাণ্ড বাতেনেই থেকে যায়। তবে ডিসিরা চলে যাওয়ার পর প্রায় সবারই অর্থনৈতিক কাণ্ডের খবর বেশ চাউর হয়। আর চলমান আমলে তো অনেক ডিসি আসার আগেই টঙ্কাকাণ্ড নিয়ে লঙ্কাকাণ্ডের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অথচ কিংবদন্তির সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বয়ানিতে খুবই উচ্চমার্গের চিত্র ফুটে উঠেছে। পিআইবির অয়োজনে এক অনুষ্ঠানে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘অন্নদা শঙ্কর রায় তখন বরিশালের ডিসি। ডিসিকে বলা হতো ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (ডিএম)। ডিএম লজে প্রত্যেক পূর্ণিমায় একটি আসর বসত। বড় বড় সাহিত্যিক আসতেন।’ অতীত প্রসঙ্গ সুখস্মৃতি রোমন্থনের জন্য আপাতত থাক।
চলমান ইলিশ প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রশ্ন হচ্ছে, যে ডিসি-এসপিরা মা ইলিশ রক্ষার মতো সাধারণ বিষয়টির ব্যবস্থাপনা করতে পারেন না, তারা ফেব্রুয়ারির নির্বাচনী পরিস্থিতি কীভাবে সামলাবেন?
দেশের মাটিতে এবং পরদেশে বাংলাদেশ নিয়ে কত খেলা চলছে! আমাদের কপালে কী আছে? শেষতক কে হাসবে, এই প্রশ্ন এখন সবার মনে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
মন্তব্য করুন