বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নিকটাত্মীয়ের রক্ত নিরাপদ নয়: সচেতন হোন

নিকটাত্মীয়ের রক্ত নিরাপদ নয়: সচেতন হোন

রক্ত মানুষের জীবনের মূল স্রোত। এ এমন এক প্রবাহ, যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনকে বয়ে নিয়ে চলে। তাই যখন কোনো পীড়িত মানুষের জীবন সংকটাপন্ন, তখন এক ব্যাগ রক্ত মৃত্যুর পদধ্বনির মাঝে জাগিয়ে তুলতে পারে জীবনের স্পন্দন। কিন্তু এ রক্তই যদি জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুর কারণ হয়? প্রশ্নটি আজ আমাদের সামনে এক গভীর বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে বহু বছর ধরে একটি প্রচলিত ধারণা সমাজে, এমনকি স্বাস্থ্য খাতে বদ্ধমূল—‘নিজের আত্মীয়ের রক্তই সবচেয়ে নিরাপদ’। রোগীর আত্মীয়রা তখন ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়, কেউ ভাইয়ের, কেউ ছেলের, কেউ পিতার রক্ত দিতে প্রস্তুত হয়। তাদের উদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু বিজ্ঞান আজ জানাচ্ছে—এ মহত্ত্বের মাঝেই লুকিয়ে আছে বিপদের ছায়া।

নিকটাত্মীয়ের রক্তে ঝুঁকি: বিজ্ঞান যা বলছে

নিকটাত্মীয়ের রক্তে ঝুঁকির বিষয়টি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। মূল সমস্যাটি ঘনিষ্ঠ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জিনগত মিলের মধ্যে।

যখন রক্ত সঞ্চালন করা হয়, তখন দাতার কাছ থেকে টি-লিম্ফোসাইট (এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা, টি-কোষও বলে) গ্রহীতার রক্তে চলে আসে। সাধারণত, গ্রহীতার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এ দাতা কোষগুলোকে ‘বহিঃশত্রু’ (foreign body) হিসেবে চিহ্নিত করে এবং প্রতিক্রিয়াস্বরূপ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার যা কর্তব্য সে তাই করে, অর্থাৎ দ্রুত তাদের ধ্বংস করে দেয়। এ প্রক্রিয়া গ্রহীতার জন্য উপকারী। তাহলে নিকটাত্মীয়ের রক্তের ক্ষেত্রে কী ব্যত্যয় ঘটে, যা জীবন বিপন্ন করে তোলে?

উত্তর হচ্ছে, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে জেনেটিক মিল। নিকটাত্মীয়রা (যেমন পিতামাতা, সন্তান বা ভাইবোন) পরস্পরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জেনেটিক উপাদান ভাগ করে নেয়, বিশেষ করে হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন (এইচএলএ/HLA)। যখন দাতা ও গ্রহীতার এইচএলএ প্রকারগুলো খুব একই রকম হয়, তখন গ্রহীতার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দাতার টি-কোষগুলোকে বহিঃশত্রু হিসেবে চিনতে ব্যর্থ হয়। ফলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার আক্রমণ থেকে তারা রেহাই পেয়ে যায়। অনিবার্যভাবে টি-কোষগুলো বেঁচে থাকে, বংশবৃদ্ধি করে এবং উল্টো গ্রহীতার শরীর দখলে (engraft) নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। দখলদার এই টি-কোষগুলো তখন গ্রহীতার টিস্যু (ত্বক, লিভার, বোনম্যারো/অস্থিমজ্জা ইত্যাদি)-কে ‘বহিঃশত্রু’ হিসেবে শনাক্ত করে এবং তাদের ওপর ধ্বংসাত্মক আক্রমণ শুরু করে। উদ্ভূত প্রতিক্রিয়াকে বলে ‘টিএ-জিভিএইচডি (TA-GVHD= Transfusion-Associated Graft Versus Host Disease); বাংলায় ‘রক্তসঞ্চালন-জনিত মেহমান বনাম মেজবান রোগ বলা যেতে পারে। এটি একটি ভয়ানক বিরূপ প্রতিক্রিয়া, যার পরিণতিতে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর হার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের বেশি, কারণ অস্থিমজ্জার ক্ষতি গুরুতর সংক্রমণ এবং রক্তপাতের দিকে পরিচালিত করে। এই আক্রমণ সাধারণত রক্ত গ্রহণের ২ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে শুরু হয় এবং দ্রুতগতিতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিকল করে মৃত্যু ঘটায়।

টিএ-জিভিএইচডি একটি বিরল জটিলতা হলেও একে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ এর কোনো কার্যকর চিকিৎসা নেই এবং মৃত্যুর আশঙ্কা প্রায় শতভাগ। ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব ব্লাড ট্রান্সফিউশন (ISBT) রিপোর্ট, বহু কেস স্টাডি, রিভিউ মৃত্যুর হার একেবারে ১০০ শতাংশ বলছে।

দেশ ও রক্তকেন্দ্র অনুসারে নিকটাত্মীয়ের পরিচয় কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে। তবে নিকটাত্মীয় বলতে সাধারণত তাদের বোঝায় যাদের জিনগত মিল সর্বাধিক। যেমন প্রথম-ডিগ্রি আত্মীয়: পিতামাতা, জৈবিক সন্তান, ভাইবোন (যাদের পিতামাতা একই); দ্বিতীয়-ডিগ্রি আত্মীয়: দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-চাচি, খালা-খালু, ভাগনে-ভাগনি, ভাতিজা-ভাতিজি, ভাইবোন (যাদের পিতামাতা ভিন্ন)।

সমাধান: বিকিরণ (Irradiation) এবং স্বেচ্ছায় বিনামূল্যে রক্তদান (VNRBD=Voluntary Non-Remunerated Blood Donation)

বিকিরণ: যদি কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে আত্মীয়ের রক্ত নিতেই হয়। তবে অবশ্যই রক্তকে ইরেডিয়েশন করে তারপর দিতে হবে। বিকিরণে লোহিত রক্তকণিকা, প্লেটলেট এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সংরক্ষণের সময় একটি নির্দিষ্ট মাত্রার গামা-রে প্রয়োগ করে দাতার টি-কোষগুলোকে নিষ্ক্রিয় (বহুগুণ করার ক্ষমতা ধ্বংস) করে ফেলা হয়। এটি টিএ-জিভিএইচডির ঝুঁকি দূর করে। তবে সবসময় নয়। টি-কোষ ধ্বংস হয়ে গেলেও কখনো কখনো এইচএলএর বিপরীতে এন্টিবডি তৈরি হতে পারে, যেটিও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণ হতে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশসহ অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশের রক্তকেন্দ্রে এই প্রযুক্তি নেই বা থাকলেও কিছু সংখ্যক রক্তকেন্দ্রে রয়েছে। যেসব হাসপাতালে অরগ্যান ট্রান্সপ্ল্যানটেশনের ব্যবস্থা আছে (যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে), সে সব রক্তকেন্দ্রে রক্ত বিকিরণের সুবিধা আছে। ফলে নিকটাত্মীয়ের রক্ত দেওয়া মানে এখানে কার্যত একটি অজানা ঝুঁকি নেওয়া।

জিন

এইচএলএ সিস্টেমের আবিষ্কার (টিএ-জিভিএইচডি ঝুঁকি বোঝার ভিত্তি) ১৯৮০ সালে জর্জ স্নেল, ডাউসেট এবং বারুজ বেনাসেরকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। আত্মীয়দের সঙ্গে টিএ-জিভিএইচডির সংযোগ ছিল সেই প্রাথমিক ও মৌলিক আবিষ্কারের একটি প্রয়োগ এবং সম্প্রসারণ। এই আবিষ্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল ছিল প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন: বিপজ্জনক দাতা টি-কোষকে ধ্বংস করার জন্য আত্মীয়দের রক্তের বাধ্যতামূলক বিকিরণ।

স্বেচ্ছায় পারিতোষিকবিহীন রক্তদান (VNRBD=Voluntary Non-Remunerated Blood Donation): বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) রক্তদান নীতিমালা ‘স্বেচ্ছায়, অর্থবিহীন রক্তদান’ (VNRBD) ব্যবস্থার ওপর কেন্দ্রীভূত। ডব্লিউএইচওর অবস্থান হলো একটি দেশের নিয়মিত রক্ত সরবরাহের জন্য ‘পারিবারিক বা প্রতিস্থাপন দাতা’ (FRD= family/replacement donor), যাদের মধ্যে নিকটাত্মীয়দের রক্ত অন্তর্ভুক্ত, তাদের ব্যবহার পর্যায়ক্রমে হ্রাস করা এবং অবশেষে বন্ধ করে দেওয়া; একই সঙ্গে ভিএনআরবিডিদের জাতীয় পুল তৈরি করা।

ডব্লিউএইচওর যুক্তি হচ্ছে, আত্মীয়স্বজন রক্তদাতা হলে সঞ্চালনের মাধ্যমে সঞ্চারিত সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। কারণ, তারা আবেগতাড়িত হয়ে বা চাপের মুখে রক্তদান করেন। ফলে তারা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য আচরণ (মাদকাসক্তি, অনিরাপদ যৌনাচার ইত্যাদি) গোপন করার চাপ অনুভব করতে পারেন, যা তাদের রক্তকে সংক্রামক রোগের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিসংখ্যানগতভাবে কম নিরাপদ করে তোলে। অন্যদিকে, পরোপকারী-নিয়মিত-স্বেচ্ছায়-অবৈতনিক দাতা, সংক্ষেপে ভিএনআরবিডিদের রক্ত স্ক্রিনিং এবং বিভিন্ন টেস্টের মাধ্যমে তা সংক্রমণমুক্ত অর্থাৎ নিরাপদ কি না, তা নিশ্চিত করা হয়। ডব্লিউএইচওর লক্ষ্য হলো সমস্ত দেশ তাদের রক্ত সরবরাহের ১০০ শতাংশ ভিএনআরবিডি গ্রুপ থেকে গ্রহণ করবে। আবার, ‘পরিবার বা প্রতিস্থাপন দানে’র বিরুদ্ধে ডব্লিউএইচওর অবস্থান নিকটাত্মীয়ের রক্তের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ওপর কার্যত একটি নিষেধাজ্ঞাও। এটি যুগপৎভাবে টিএ-জিভিএইচডির ঝুঁকি হ্রাস করাকেও প্রবলভাবে সমর্থন করে।

স্বেচ্ছায় রক্তদান: মানবতার বিজ্ঞান

১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২ নভেম্বর ‘জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস’ পালিত হচ্ছে—আলোচ্য বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মূলত ‘পরিবর্তিত বিজ্ঞান মোটেই সব ধরনের স্বেচ্ছায় রক্তদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং তা স্বেচ্ছায় রক্তদানকে আধুনিক ট্রান্সফিউশন বিজ্ঞানের মেরুদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এটি একটি উপলব্ধি, যা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জিনগত মিলের জন্য রক্তগ্রহীতাকে একটি ভয়াবহ জটিলতা থেকে রক্ষা করে। এর পরিবর্তে দাতারা যখন কোনো অর্থ বা আত্মীয়তার বিনিময়ে নয়, মানবতার তাগিদে রক্ত দেন, তাদের রক্ত হয় সংক্রমণমুক্ত, পরীক্ষিত ও সঠিকভাবে সংরক্ষিত। বিশ্বাস, আভিজাত্য বা সম্পর্কের বাঁধ ভেঙে একজন মুসলিমের রক্ত বইতে পারে হিন্দুর দেহে, শ্রমিকের রক্ত বইতে পারে মালিকের দেহে, শত্রুর রক্ত বইতে পারে মিত্রের দেহে। রক্তদানের আধুনিক দর্শন হলো—Donate blood regularly, not for your kin, but for your kind

লেখক: জনস্বাস্থ্য ও হাসপাতাল প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মারা গেলেন ইরফান পাঠান-আম্বাতি রাইডুদের সাবেক সতীর্থ

দুই ভাইকে হত্যার ঘটনায় মামলা, গ্রেপ্তার ৩

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ ঢাকার

ফের জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান

আপিল বিভাগের শুনানি পর্যবেক্ষণে নেপালের প্রধান বিচারপতি

ইনুর বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ ট্রাইব্যুনালের

৩১ দফা বাস্তবায়ন অপরিহার্য : অপু

সড়কের কাজ ফেলে লাপাত্তা ঠিকাদার

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্যাম্পেইন শুরু

স্মিথকে নিয়ে নিউজিল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি স্কোয়াড ঘোষণা

১০

পাকিস্তান কি গোপনে ভয়ংকর কোনো অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে?

১১

সাভারে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১২

ক্যারিয়ারে প্রথম ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট জিতলেন এমবাপ্পে

১৩

ছেলের লাঠির আঘাতে প্রাণ গেল বাবার

১৪

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় যুবক উদ্ধার

১৫

বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় যুবকের কাণ্ড

১৬

নেপালে এভারেস্টের পাদদেশে আটকা শতাধিক পর্যটক

১৭

রেস্টুরেন্ট স্বাদের অরেঞ্জ চিকেন রেসিপি এখন আপনার রান্নাঘরেই

১৮

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়ে শফিক তুহিনের গান ‘মানবতার জয় হোক’

১৯

বাংলাদেশের পরবর্তী সিরিজ কবে কখন, দেখে নিন পূর্ণাঙ্গ সূচি

২০
X