‘মাদার অব ফিশারিজ’ খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওর প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিশাল বিস্তৃত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি ৯ কুড়ি কান্দা, ৬ কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত।
১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই অবসান হয় দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারি প্রথা। ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। সারি সারি হিজল-করচ বাগান, পরিযায়ী পাখি, বিভিন্ন প্রজাতি দেশীয় মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর বিশাল এই অভয়াশ্রমটি সুরক্ষায় প্রথম পর্যায়ে জেলা প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ও আনসার সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকত। বর্তমানে হাওরে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট নেই, ১৬ জন আনসার সদস্য বিশাল হাওরটি দেখভাল করেন। নামেই এখন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। কার্যত অবাধে নির্বিচারে ধ্বংস হচ্ছে বিখ্যাত এ হাওরটি।
গত ২২ বছরে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ঘিরে পর্যটন বিকশিত হলেও ধ্বংসের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে হাওরের জীববৈচিত্র্য। কমে গেছে হাওরের সুস্বাদু মাছ, হিজল-করচগাছ ও জলজ উদ্ভিদ। একসময়ের পাখির এ অভয়াশ্রমে এখন পাখির দেখাও মেলে না। হারিয়ে গেছে অনেক বিলও।
টাঙ্গুয়ার হাওর সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশকর্মী আহমদ কবির বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই হলো গাছগাছালি, যা হাওরের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ হাওরে ঘুরতে আসা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি, বর্ষাকালে টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ-টাওয়ার সংলগ্ন করচের বাগানে পর্যটকদের ভিড় জমে, পানিতে নেমে হইহুল্লোড় করে। উচ্চস্বরে গানবাজনা করে, যা হাওরের পরিবেশকে দিন দিন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছে।
জানা যায়, প্রয়াত বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন একজন প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন। তিনি টাঙ্গুয়ার হাওরে ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর ধরে নিরলসভাবে ৯০ হাজার করচ গাছ ও কিছু হিজল গাছ লাগিয়েছেন। টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ রক্ষায় একজন সত্যিকারের যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এ ছাড়া তাহিরপুরের আরেকটি অন্যতম পর্যটন স্পট এশিয়ার বৃহত্তম শিমুল বাগানও তিনি নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন বলেন, যে কারণে টাঙ্গুয়ার হাওরকে প্রতিবেশগত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। গত ২২ বছরে তার কোনো ভালো ফল মিলেনি। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের ভেতরে থেকেই হাওরটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. ইলিয়াস মিয়া বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ প্রতিবেশের কথা চিন্তা করে পর্যটন ব্যবস্থার ওপরে জেলা প্রশাসনের নীতিমালাও রয়েছে; কিন্তু এ মুহূর্তে নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসনের যে লোকবল দরকার, তা নেই।
মন্তব্য করুন