

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ব্যবসাকে ডিজিটালাইজ এবং ডেটা-ড্রিভেন করার মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘বেচো’ প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে।
মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) অনলাইন সেলারসহ ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার জন্য তৈরি নতুন অল-ইন-ওয়ান ম্যানেজমেন্ট প্ল্যাটফর্ম ‘বেচো’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটারে। প্ল্যাটফর্মটি ক্ষুদ্র ব্যবসার দৈনন্দিন কার্যক্রমগুলোকে ডিজিটালভাবে পরিচালনা করতে সহায়তা করবে। যাতে উদ্যোক্তারা ডেটানির্ভর পদ্ধতিতে ব্যবসা বাড়াতে পারেন এবং ভবিষ্যতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের প্রথম সারির বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন বহুজাতিক ও টেলিকম কোম্পানির প্রতিনিধি, তরুণ উদ্যোক্তা এবং শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে একটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্যানেল আলোচনার পর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বেচো’ প্রোডাক্ট উদ্বোধন ও নেটওয়ার্কিং সেশন অনুষ্ঠিত হয়।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন দেশের ব্যাংকিং ও নীতিনির্ধারণী অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা— তারা হলেন- নওশাদ মুস্তাফা, ডিরেক্টর, এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক; ওসমান এরশাদ ফায়েজ ফায়েজ ফায়েজ, অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এএমডি), ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি; সৈয়দ আবদুল মোমেন, অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও হেড অব এসএমই ব্যাংকিং, ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি।
প্যানেলিস্টরা বাংলাদেশের সিএমএসএমই খাতের পরিবর্তনশীল চিত্র, সোশ্যাল কমার্সের দ্রুত বিকাশ এবং কেন এখনো অনেক ছোট উদ্যোক্তা প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়নের বাইরে থেকে যাচ্ছেন, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
তারা জোর দিয়ে বলেন, নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল রেকর্ড, বিকল্প ডেটা এবং প্রযুক্তি–নির্ভর স্কোরিং মডেলই ‘আনব্যাংকড’ এবং ‘আন্ডারব্যাংকড’ উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের দুয়ার উন্মুক্ত করতে পারে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. ডেভিড ডাউল্যান্ডের বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রোডাক্ট ডেমোনস্ট্রেশন প্রেজেন্টেশনে বেচো-এর কো-ফাউন্ডার ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহরিয়ার খান সাজিদ প্ল্যাটফর্মটির মূল সমাধানগুলো উপস্থাপন করেন।
সমাপনী বক্তব্যে বেচো লিমিটেডের চেয়ারম্যান মৃধা মো. আরিফুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে তরুণ, মোবাইল–ফার্স্ট জনগোষ্ঠী এবং ১০ কোটিরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর বদৌলতে এক অসাধারণ ডিজিটাল কমার্স প্রবৃদ্ধি তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ প্রবৃদ্ধির বড় একটি অংশ এখনো অনানুষ্ঠানিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থার কাছে প্রায় অদৃশ্য।
বাংলাদেশে বর্তমানে আনুমানিক পাঁচ লক্ষাধিক সক্রিয় এফ-কমার্স ও সোশ্যাল কমার্স পেজ রয়েছে, যাদের অনেকগুলোই নারী উদ্যোক্তাদের দ্বারা পরিচালিত। শুধু এই সেক্টরটির সম্ভাব্য বাজারমূল্য প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এই ব্যবসাগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশই নারী–নেতৃত্বাধীন। ফলে সোশ্যাল কমার্স বাংলাদেশের নারী নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির অন্যতম শক্তিশালী ইঞ্জিনে পরিণত হয়েছে।
তবুও বেশিরভাগ সেলার এখনো খাতায়-কলমে হিসাব রাখেন, ম্যাসেঞ্জার বা চ্যাটের বিচ্ছিন্ন কথোপকথনের ওপর নির্ভর করেন, ক্যাশ-অন-ডেলিভারি ও বিচ্ছিন্ন লজিস্টিকস ব্যবস্থার মাধ্যমে কাজ পরিচালনা করেন—যার ফলে তাদের কোনো সুসংহত ডেটা বা যাচাইযোগ্য ক্রেডিট হিস্ট্রি তৈরি হয় না।
মৃধা মো. আরিফুজ্জামান আরও বলেন, এই ডেটা গ্যাপ-ই বহু পরিশ্রমী উদ্যোক্তাকে ঋণ পাওয়ার অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করে রাখে। ‘বেচো’ মূলত এই লুকায়িত অর্থনীতির জন্য একটি অপারেটিং সিস্টেম—যাতে উদ্যোক্তাদের পরিশ্রম, সততা এবং ব্যবসার প্রকৃত পারফরম্যান্স ডেটায় প্রতিফলিত হয়, আর সেই ডেটাই ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
বেচো : অনলাইন ও সোশ্যাল কমার্সের জন্য নতুন প্রজন্মের অপারেটিং সিস্টেম
‘বেচো’ একটি একীভূত মোবাইল প্ল্যাটফর্ম, যেখানে একজন সেলার একই ড্যাশবোর্ড থেকে পণ্য, অর্ডার, পেমেন্ট এবং ডেলিভারি ম্যানেজ করতে পারেন। অ্যাপটি ব্যবহার করে উদ্যোক্তারা পারেন— মিনিটের মধ্যে পেশাদার মানের একটি অনলাইন ওয়েবস্টোর তৈরি করতে। বিভিন্ন সোশ্যাল চ্যানেল থেকে আসা অর্ডার সিঙ্ক ও ট্র্যাক করতে। একই জায়গা থেকে একাধিক লজিস্টিকস পার্টনার অ্যাসাইন ও মনিটর করতে। অটোমেটেড বুককিপিং ও ইনভেন্টরি রেকর্ড বজায় রাখতে। বড় প্রতিষ্ঠানের মতোই সিআরএম (CRM) টুলস ও বিজনেস অ্যানালিটিক্সের সুবিধা নিতে।
এই সব কার্যক্রমকে ডিজিটাল করে ‘বেচো’ উদ্যোক্তাদের ভুল কমাতে, অপারেশনাল খরচ কমাতে এবং ধারাবাহিক একটি ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট তৈরি করতে সহায়তা করে।
কো–ফাউন্ডার শাহরিয়ার খান সাজিদ ‘বেচো’-র অগ্রযাত্রার তিন ধাপের রোডম্যাপ তুলে ধরেন— ১. ফেইজ ১ – অপারেশন সহজীকরণ : দৈনন্দিন ব্যবসা পরিচালনা সহজ করা এবং ছোট ব্যবসাগুলোকে একটি কাঠামোবদ্ধ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা।
২. ফেইজ ২ – অর্থায়নের সুযোগ : বিক্রির ট্রেন্ড, ডেলিভারি পারফরম্যান্স, কাস্টমার হিস্ট্রি ইত্যাদি অপারেশনাল ডেটার ভিত্তিতে বিকল্প ক্রেডিট স্কোর তৈরি করা। এই স্কোরের মাধ্যমে পার্টনার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচলিত কাগজপত্রের ওপরে নির্ভরতা কমিয়ে এসব উদ্যোক্তাকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন দিতে পারবে।
৩. ফেইজ ৩ – ইউনিফাইড ইকোসিস্টেম: রিটেইলারদের সরাসরি সরবরাহকারী ও নির্মাতাদের সাথে যুক্ত করে - সোর্সিং, সেলিং, লজিস্টিকস এবং ফাইন্যান্স সবকিছু একত্রিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ ইকোসিস্টেম তৈরি করা।
মৃধা মো. আরিফুজ্জামান বলেন, আমাদের ভিশন হলো কোনো ব্যবসাই যেন ‘টু স্মল টু কাউন্ট’ না থাকে। একজন সেলার যদি প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত অর্ডার ডেলিভার করে, গ্রাহক সেবা দেয় এবং আয় বাড়ায় তবে সেই চিত্রগুলো ডেটায় আসা উচিত, আর সেই ডেটাই তার জন্য ফাইন্যান্সের দরজা খুলে দেবে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা উল্লেখ করেন, সিএমএসএমই খাতের চ্যালেঞ্জ সমাধানে কেবল একটি প্ল্যাটফর্ম যথেষ্ট নয়; এর জন্য দরকার রেগুলেটর, ব্যাংক, প্রযুক্তি কোম্পানি, লজিস্টিকস, পেমেন্ট পার্টনার এবং একাডেমিয়ার সমন্বিত উদ্যোগ। বাংলাদেশ ব্যাংক, শীর্ষস্থানীয় কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এন্টারপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট এর প্রতিনিধিদের উপস্থিতি একটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তুলতে সবার যৌথ অঙ্গীকারকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।
সন্ধ্যার শেষ পর্বে ‘বেচো’ অ্যাপের লাইভ ডেমো দেখানো হয়, যেখানে প্রদর্শন করা হয় কীভাবে একজন ছোট অনলাইন সেলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্টোর সেটআপ, ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট এবং লজিস্টিকস কানেক্ট করতে পারেন। পরে অতিথিরা নেটওয়ার্কিং সেশনে অংশ নিয়ে ভবিষ্যৎ পার্টনারশিপ ও সিএমএসএমই ডিজিটাইজেশন নিয়ে সম্ভাব্য কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন।
মন্তব্য করুন