বাসস
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘ছোট একটা ছেলে, ওকে কীভাবে গুলি করতে পারল?’

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী। ছবি : সংগৃহীত
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী। ছবি : সংগৃহীত

পড়ালেখা না শিখিয়ে যদি আমার সাথে ছেলেডারে ব্যবসায় বসিয়ে দিতাম, তাহলে আমি তারে হারাইতাম না। কেন যে আমি ওরে শিক্ষিত বানাইতে গেলাম? ওর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী। শিক্ষিত বানাইতে গিয়ে ওরে আমি নিজ হাতে মেরে ফেললাম।

কে জানতো ছেলেটা এই অসময়ে চলে যাবে। আমি চেয়েছিলাম ও আমাকে কাঁধে নিয়ে গিয়ে কবর দেবে। কিন্তু এই বুড়ো বয়সে আমি আমার ছেলের লাশ কাঁধে করে কবরস্থানে নিয়ে গেছি। ওকে কবরে নামিয়ে শুইয়ে এসেছি। একজন বাবা হিসেবে এটা আমার জন্য যে কত কষ্টের সেটা আমি বুঝাতে পারব না। এই বলে কাঁদতে থাকেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ আব্দুল্লাহ সিদ্দিকীর বাবা আবু বক্কর সিদ্দিকী।

তিনি বলেন, আমার অনেক ইচ্ছা ছিল ছেলেমেয়েরে লেখা পড়া শিখানোর। আমি কষ্ট করে ওদের লেখাপড়া শিখিয়েছি। কিন্তু আমার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে একমাত্র ছেলেরে হারিয়ে ফেললাম। ছেলেডারে মেরে ফেললাম।

আব্দুল্লাহর ছোটোবেলার একটা ছবি দেখিয়ে ওর স্মৃতিচারণ করে তার বাবা বলেন, ওর তো সুন্দরভাবে জীবন কাটানোর কথা ছিল। কেন ছেলেডারে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হলো? এই তো কয়েক বছর আগেই ও খেলত, ঘুরে বেড়াত। ছেলেটার মায়াবী মুখ ছিল। ও অনেক মেধাবী ছিল। ছোট একটা ছেলে। ওরে কিভাবে গুলি করতে পারল? ওরা না হয় আমারে দুইটা গুলি করত।

প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে তিনি বলেন, অনেক চেষ্টা করেছি প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু পারি নাই। আমার একটা ইচ্ছা প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করার। আমার ছেলেটা দেশের জন্য জীবন দিল, আর কেউ আমার সাথে দেখাও করল না। এটা আমার জন্য খুব কষ্টের। আমি প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করতে চাই।

শহীদ আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী ২০০৩ সালের ১৩ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। ২১ বছর বয়সী টগবগে এই যুবক হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের ২১-২২ শিক্ষাবর্ষের মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। আবদুল্লাহর সিফা সিদ্দিকী ও আফ্রিন সিদ্দিকী সাফা নামে দুই বোন রয়েছে। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেলেও ছোট বোন সাফা স্থানীয় একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ৪ আগস্ট বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর ঝিগাতলায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী। বুকের ডান পাশে গুলি লাগে আব্দুল্লাহর। পরে ৫ আগস্ট জোহরের নামাজের পর রায় শাহ বাজার মসজিদে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।

সেদিন আব্দুল্লাহর সাথে যারা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের বরাত দিয়ে আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, আমি ওই দিন সকালে ওরে কিছু টাকা দিয়ে দোকানে থাকার কথা বলে সিলেট যাই। পরে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফোনে খবর পাই আন্দোলন করতে গিয়ে আব্দুল্লাহর পায়ে গুলি লাগছে। এটা শুনে আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন করে ওঠে। তখন ওর বন্ধুকে বলি আব্দুল্লাহকে ফোনটা দিতে। ওই পাশ থেকে বলে সে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তখন আমি যা বোঝার বুঝে ফেলি এবং তাড়াতাড়ি ঢাকায় ফিরে আসার চেষ্টা করি।

বন্ধুদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসক ওকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে আমাকে ওর বন্ধুরা ফোন করে জানতে চায় এখন ওর লাশ কি করবে। আমি ওদের বলি, লাশ বাসায় পৌঁছে দিতে।

সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আব্দুল্লাহ সিদ্দিকীর বাবা আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, সব শহীদ ও আহতদের যেন সরকারি কোষাগার থেকে সহযোগিতা করা হয়। শুধু মুখে শহীদ বললেই হবে না, তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যত শহীদ হয়েছেন, তাদের সবার কবরে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানাতে হবে।

সব শহীদের পরিচয়পত্র দেওয়ার পাশাপাশি তাদের পিতা ও মাতাকেও পরিচয়পত্র দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, গণভবনে যে জাদুঘর করা হচ্ছে, সেখানে সব শহীদ ও আহতের ছবি রাখতে হবে। সরকার থেকে বারবার বলা হচ্ছে, প্রত্যেক শহীদের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হবে। আমার প্রশ্ন এটা কেন বলা হচ্ছে? একটা জীবনের মূল্য কি ৩০ লাখ টাকা? এটা বলে শহীদদের অপমান করা হচ্ছে।

শহীদ আব্দুল্লাহর মা আবেদা সুলতানা বলেন, সকালে ছেলে আমার খিঁচুড়ি খেয়েছিল। ওই খাওয়াই যে ওর শেষ খাওয়া হবে তা তো আমি জানতাম না। ৪ আগস্ট সকালে আমি ছেলেকে বলেছিলাম, আন্দোলনে একা যাইস না, গেলে আমাকে নিয়ে যাইস। আমি বুঝতে পারি নাই, ছেলে আমার শহীদ হবে। আমি এই হত্যার বিচার চাই।

তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ একটা বাইক ও ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা কিনতে চেয়েছিল। সেজন্য সে টাকাও কিছু জোগাড় করেছিল। কিন্তু তা আর হলো না। আমার ছেলেডারে গুলি করে মারা হলো। গত ১৩ অক্টোবর ওর জন্মদিন ছিল। এই বছর আর জন্মদিন পালন করা হলো না। আমার ছেলে জীবন দিয়ে দ্বিতীয়বার দেশ স্বাধীন করেছে। আমি চাই আমার ছেলে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেন শহীদের মর্যাদা পায়।

আব্দুল্লাহর ছোট বোন আফ্রিন সিদ্দিকী সাফা বলেন, ওই দিন (৪ আগস্ট) ভাইয়া বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমাকে বলেছিল, খরগোশগুলোকে খাবার দিতে। আরও বলেছিল, খরগোশের খাওয়ার জন্য ঘাস একটু কম আছে। আমি যেন সেই খাবারগুলো হিসেব করে খরগোশকে খেতে দেই। খরগোশগুলো আছে, কিন্তু ভাইয়া আর নেই। এই বছর ভাইয়ার জন্মদিন আর পালন করা হলো না।

আব্দুল্লাহর বান্ধবী নূর নাহার বলেন, আন্দোলনে অংশ নিয়ে আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী ঝিগাতলায় শহীদ হয়েছে। তার বুকের ডানপাশে গুলিটি বিদ্ধ হয়। আব্দুল্লাহ খুব ভালো ছেলে ছিল। সবার সাথে মিশতে পারত। ওকে খুব মিস করি।

হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আলী বর্দ্দিন বলেন, আব্দুল্লাহ আমাদের সবার জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার আদর্শ ও আত্মত্যাগ আমাদের ন্যায়ের পথে চলতে সবসময় অনুপ্রাণিত করবে। তার আত্মত্যাগ শুধু আমাদের কলেজ নয়, সমগ্র সমাজের জন্য একটি অনুপ্রেরণার উৎস। আব্দুল্লাহর মতো সাহসী যুবকদের কারণেই সমাজে পরিবর্তন আসে। আমাদের উচিত তার আদর্শকে বুকে ধারণ করে একটি উন্নত, সুশৃঙ্খল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শিক্ষার্থী চারজন, পরীক্ষা দেওয়া দুজনের কেউ পাস করেনি

ধারাবাহিকের মূল ভূমিকায় হেদায়েত উল্লাহ তুর্কী 

রাকসু নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৭০ শতাংশ

খতমে নবুওয়তের চেতনায় সত্য ও ন্যায়ের পথে এগিয়ে যাক কালবেলা : মুহিউদ্দীন রাব্বানী

এইচএসসির ফল পুনর্নিরীক্ষণ আবেদন করবেন যেভাবে

চট্টগ্রামে আগুন ৪ ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি, ২৫ শ্রমিককে উদ্ধার

চীনে ৩০ পাদরি গ্রেপ্তার, বড় অভিযানের আশঙ্কা

মোস্তারির অর্ধশতকে অজিদের বিপক্ষে বাংলাদেশের লড়াকু সংগ্রহ

‘ভর্তির পরে সবার বিয়ে হয়ে গেছে, তাই কেউ পাস করেনি’

সর্বপ্রথম কোথায় আজান হয়েছিল, কার কণ্ঠে?

১০

নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের পথ মসৃণ হবে : মির্জা ফখরুল

১১

রাকসু নির্বাচন ঘিরে নানা অভিযোগ ছাত্রদল প্যানেলের ভিপি প্রার্থীর

১২

যমুনা ঘেরাও কর্মসূচি স্থগিত, আন্দোলনরত শিক্ষকদের বড় কর্মসূচি ঘোষণা

১৩

গাজায় সৈন্য পাঠাতে যাচ্ছে পাকিস্তান, আজারবাইজান ও ইন্দোনেশিয়া!

১৪

রংপুর ক্যাডেট কলেজে শতভাগ জিপিএ ৫

১৫

‘ইলেকশন ইন ফেব্রুয়ারি’ স্লোগানে ঢাবিতে ছাত্রদলের মিছিল 

১৬

টাঙ্গাইলে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ৪

১৭

নেসলের ১৬ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা

১৮

বাবা হলেন হাসনাত আব্দুল্লাহ

১৯

রাকসু নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু

২০
X