সিলেটে ফ্রি চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন ইউরোপের ৫০ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার
অসহায় দরিদ্র মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতে ইউরোপ থেকে ৫০ জনের একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিম সিলেটে এসেছেন। লন্ডন থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকদের সমন্বয়ে তাদের বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে তাফিদা রাকিব ফাউন্ডেশন।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সিলেটে পৌঁছান এই বিশেষজ্ঞ দলটি। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, হার্ট ফাউন্ডেশন বার্ড চক্ষু হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গাতে সাত দিনব্যাপী চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ফাউন্ডেশন থেকে চিকিৎসার মেডিসিনসহ বিভিন্ন সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল থেকে অপারেশন কার্যক্রম চলছে। সিলেটের বিভিন্ন গ্রাম থেকে স্বেচ্ছাসেবী দ্বারা রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তার এবং বিদেশি ডাক্তারদের সমন্বয়ে চলছে এই ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প। ক্যাম্পে গাইনি, ফিজিক্যাল মেডিসিন, নাককান গলা, সার্জারিসহ ৭টি বিষয়ে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শ্বাসতন্ত্র, ইউরো, রক্তনালী, ভাস্কোলার সার্জনসহ বিভিন্ন রোগের ডাক্তাররা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।
চিকিৎসকদের দলে আছেন ফ্রান্সের স্বনামধন্য কার্ডিয়াক সার্জন অধ্যাপক ফিলিপ মেনাশে, ইংলান্ডের অধ্যাপক ম্যাথিয়াস ও অধ্যাপক কুমারান। এ ছাড়াও যুক্তরাজ্য থেকে এনেসথেসিয়া বিভাগের ৫ জন ডাক্তার, কার্ডিওলজি বিভাগের ৩ জন ডাক্তার, ইমার্জেন্সি মেডিসিন বিভাগের ৯ জন ডাক্তার, ইউএনটি বিভাগের ১ জন ডাক্তার, নিউরো ফিজিওথেরাপিস্ট ১ জন, আমেরিকা থেকে নিউরোলজিস্ট ১ জন, যুক্তরাজ্য থেকে ৩ জন এবং ফ্রান্স থেকে ১ জন, চক্ষুরোগবিশেষজ্ঞ ৬ জন, যুক্তরাজ্য থেকে অর্থোপেডিক্স ১ জন, ইতালি থেকে অর্থোপেডিক্স ১ জন, ফ্রান্স থেকে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ১ জন এবং যুক্তরাজ্য থেকে ২ জন, ফার্মাসিস্ট ১ জন, পূর্ণবাসন বিষয়ে কনসাল্টটেন্ট এর জন্য ২ জনসহ ৫০ জন।
বাংলাদেশে এই ৫০ জন বিশেষজ্ঞ মেডিকেল ডাক্তারদের আনা-নেওয়া বাবদ প্লেনের টিকিট ভাড়া অ্যামিরেটস এয়ারলাইন্স বিনা পয়সায় দিয়েছে। স্থানীয় হোটেল তাদের থাকা-খাওয়া বাবদ খরচ ডিসকাউন্ট দিচ্ছে। এ ছাড়াও টমি মিয়া ইন্সটিটিউট এর পক্ষ থেকে খাবারের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
তাফিদা রাকিব ফাউন্ডেশন-এর সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা শেলিনা বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য একটি অভূতপূর্ব সুযোগ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসকদের একত্রিত করার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের অগণিত অসহায় দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছি।’
২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই মেডিকেল ক্যাম্পেনিং চলবে আগামী ৪ মার্চ পর্যন্ত । মেডিক্যাল ক্যাম্প শেষে ৬ মার্চ বাংলাদেশ ছাড়বেন ইউরোপের এই চিকিৎসক দলটি।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন মিলি বেগম। চিকিৎসকের পরামর্শ পেয়ে তিনি কালবেলাকে বলেন, 'মনো করছিলাম একজন ডাক্তর রোগী দেখবা। কিন্তু আইয়া দেখি, বাক্কা ডাক্তার আইচইন। ভালা করি দেখচইন ওষুধ লেইক্কা দিচইন। কিছু ওষুধপাতি ফ্রিও দিসইন, আমি খুব খুশি অইছি আমার পোয়ারে ডাক্তার দেখাইতে পারিয়া, তারা হকলের লাগি মন থাকি দোয়া করি।’
চিকিৎসা নিতে আসা আরেক রোগীর অভিবাবক মোক্তার মিয়া বলেন, ‘যেখানে সরকারি হাসপাতালে আসলে আমরা ডাক্তারদের খোঁজ পাই না, সেখানে আমরা বিদেশি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দ্বারা আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা নিতে পেরেছি। আশা করব ভবিষতেও এই রকম মহৎ কাজ অব্যাহত থাকবে।’
সুনামগঞ্জ থেকে আসা শ্বাসকষ্টের রোগী আঞ্জুমারা ডাক্তারদের সেবা পেয়ে কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ, এত নামিদামি ডাক্তারদের দ্বারা চিকিৎসাসেবা নিতে পেরে সন্তুষ্টি প্রকাশ করছি।’
তাফিদা রাকিব ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এই ট্রিটমেন্ট বাংলাদেশে কনটিনিউ করে যাব, আপনারা সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমাদের পরিকল্পনা, গ্রাম অঞ্চলের গরিব অসহায় মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাওয়া। সিলেটে ওসমানী মেডিকেল, হার্টফাউন্ডেশনসহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় ফ্রি ক্যাম্পেনিং এর মাধ্যমে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশে বিদেশি চিকিৎসকদের এত বড় মেগা মেডিক্যাল ক্যাম্প এর আগে আর হয়নি বলেও জানান তিনি।
সংগঠক মোহি আহাদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠার পরপরই আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, বিশ্বের সর্বত্র অসহায়দের চিকিৎসাসেবা দেওয়া। আমরা শুরু করেছি বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশে যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন এবং যাদের চিকিৎসার খরচ চালানো সম্ভব না, মূলত তাদের জন্যই আমরা ৫০ এর বেশি ডাক্তার নিয়ে এসেছি এবং সিলেটে ক্যাম্প করেছি। আমরা সিলেটে ওসমানী মেডিকেল, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন এবং দুটো চক্ষুরোগ হসপিটালের সঙ্গে সমন্বয় করে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমরা ইতোমধ্যে ২ হাজারের বেশি রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছি এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু সার্জারিও আমরা সম্পন্ন করেছি। আমরা যেহেতু সিলেটের বিভিন্ন মেডিকেলের সাথে সমন্বয় করে কাজ করছি, সেজন্য কোনো রোগীর ফলোআপ চিকিৎসা সেই হসপিটালের তত্ত্বাবধানেই হবে। আমাদের সঙ্গে যারা স্পন্সরশিপে আছেন তাদেরকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যারাই আমাদের এই স্বেচ্ছাসেবী কাজে সহায়তা করছেন সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’
সংগঠক মধু জানান, ‘আমরা যারা বিদেশে বাংলাদেশিরা বসবাস করি, আমরা বিদেশ থেকে ভালো ভালো ডাক্তারদের আনার চেষ্টা করি এবং এই দেশের অসহায় হতদরিদ্রদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করতেছি। সিলেট থেকে শুরু হয়েছে। ইনশাল্লাহ, আমরা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার আশা রাখি।’
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেন, তাফিদা রাকিব ফাউন্ডেশন যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠানটি গত এক মাস যাবত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা সিলেট অঞ্চলের অসহায় মানুষদের সেবা করতে চান। যার প্রেক্ষিতে তারা আমাদের এখানে গত ২৬ ফ্রেব্রুয়ারি আসেন এবং ২৭ তারিখ থেকে তারা তাদের চিকিৎসা সেবা শুরু করেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো গরীব দুস্থ অসহায়দের চিকিৎসা সহায়তা ও বিনামূল্যে ওষুধপত্র বিতরণ করে সাহায্য করা। তারা এককভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন না। আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা চিকিৎসা দিচ্ছেন। আমাদের ডাক্তাররা তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের চিকিৎসক এবং বিদে চিকিৎসকদের মধ্যে উৎসব উৎসব আবহ বিরাজ করছে, একই সঙ্গে এত বেশি রোগী দেখে কেউই অভ্যস্ত না। তারাও আমাদের ডাক্তার থেকে শিখতে পারছেন, আমাদের ডাক্তাররাও তাদের থেকে অনেক কিছু শিখতে পারছে। এরই মাধ্যমে উভয়পক্ষ্যের মধ্যে একটি সুন্দর যোগসূত্র সৃষ্টি হচ্ছে। আমরাও চাই উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করতে। তাদেরকে অবশ্যই বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য, তাফিদা রাকিব ফাউন্ডেশন লন্ডনে ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছর যুক্তরাজ্যের চিকিৎসকরা জটিল রোগে আক্রান্ত তাফিদা রাকিব নামের ৪ বছর বয়সী একটি শিশুর বাঁচার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে লাইফ সাপোর্ট খুলে নিতে বললে চিকিৎসকদের সিদ্ধান্তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করে তাফিদার পরিবার। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর তাফিদাকে ইতালির জেনোয়াতে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার অনুমতি পায় পরিবারটি। সুস্থ হয়ে ওঠে শিশুটি। এর পরই বিশ্বব্যাপী অসহায় শিশুদের চিকিৎসা সেবায় তাফিদা রাকিব ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন শিশুটির মা সেলিনা বেগম। যা যুক্তরাজ্য ও ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রশংসিত হয়।
০২ মার্চ, ২০২৪