মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৫ এএম
আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যয় বেড়েছে, দেশে বাড়েনি কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ
প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রগতি হলেও বিশেষায়িত সেবা সম্প্রসারণ সম্ভব হয়নি। এখনো ক্যান্সার, কিডনি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের বিশেষায়িত চিকিৎসা রাজধানীকেন্দ্রিক। ফলে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ বহন করতে হচ্ছে ব্যক্তিকে। এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রস্তাবিত হারের প্রায় তিন গুণ। আর্থিক যে চাপ বাড়ছে, সেটা সামলাতে হিমশিম খেয়ে অনেকে পূর্ণ চিকিৎসা গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করছেন। এতে রোগ আরও জেঁকে বসছে।

স্বাস্থ্য হলো জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) একটি অপরিহার্য অংশ। এসডিজির ৩ দশমিক ৮ টার্গেটে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে—সব মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্মত চিকিৎসাসেবা পাবে এবং নাগরিকরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল হলেও চিকিৎসাসেবা পেতে গিয়ে আরও দরিদ্র হয়ে পড়বে না। ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে অঙ্গীকারবদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের মাঝে সুস্বাস্থ্যের গুরুত্ব তুলে ধরার প্রয়াসে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে প্রতি বছর ৭ এপ্রিল পালন করা হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। ১৯৪৮ সালের এই দিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য হলো—‘মাই হেলথ, মাই রাইট (স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিতে: কাজ করি একসঙ্গে)’।

দিবসটি উপলক্ষে গতকাল শনিবার রাজধানীর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব কনভেনশন হলে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতে কাজ করছে। এজন্য দেশের প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত চিকিৎসা পৌঁছে দিতে হবে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যদি ঠিকভাবে কাজ করে, তাহলেই তা সম্ভব। আমি এজন্য আপনাদের যত রকম সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করব। আপনারা আমাকে সেবা দিন, আমি প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করব।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার খুরশিদ আলম বলেন, দেশে ডাক্তারের সংখ্যা ১০ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার। দেশে বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা শুরু করায় অফিসে উপস্থিতি বেড়েছে। আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে ৫০০টি। এর মধ্যে ৫০ শয্যার হাসপাতাল আছে ৩৭৬টি। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি বেড়েছে, শিশু মৃত্যুহার কমেছে। ইপিআই টিকাদান প্রায় ৯৪ শতাংশ সফল হয়েছে। রাতকানা রোগ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বর্তমানে পাঁচ বছরের কম বয়সী খর্বকায় শিশুর জন্মের সংখ্যা ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নূরুল হক বলেন, স্বাস্থ্য খাতে প্রচুর স্থাপনা আর অবকাঠামো থাকলেও পর্যাপ্ত জনবল আর অর্থ নেই। ফলে দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। এগিয়ে যেতে হলে আমাদের প্রচুর কাজ করতে হবে। আর কাজ করতে হলে দক্ষ জনবল লাগবে। এজন্য লাগবে অর্থ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনেও অপর্যাপ্ত জনবলের কথা বলা হয়েছে। শুধু চিকিৎসক-নার্স দিয়েই স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। যদিও দেশে বর্তমানে ৪০ শতাংশের মতো হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্টের পদ ফাঁকা রয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ১৯৯৭-২০ সাল পর্যন্ত সরকারের অংশের ব্যয় ক্রমান্বয়ে কমছে এবং ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বেড়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্যানুযায়ী, পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচারের (ওওপি) হার বেশ বেশি। সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তিগত ব্যয়ের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে আফগানিস্তান। এরপরের অবস্থানে বাংলাদেশ।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্যানুযায়ী, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় কমে ২০২০ সালে ২৩ শতাংশে নেমেছে। এর আগে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে এ হার ছিল যথাক্রমে ২৮ ও ২৬ শতাংশ। আবার ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয়ের অবদান ছিল যথাক্রমে ৬৪ ও ৬৬ শতাংশ। ২০১২ সালে বাংলাদেশিরা পকেট থেকে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬২ শতাংশ ব্যয় করত। ওই বছর কর্তৃপক্ষ ‘হেলথ কেয়ার ফাইন্যান্সিং স্ট্র্যাটেজি ২০১২-৩২’ প্রণয়ন হয়, যার লক্ষ্য ছিল ২০৩২ সালের মধ্যে আউট অব পকেট স্বাস্থ্য এক্সপেন্ডিচার ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনা। বরং ব্যয় নিচে আসার পরিবর্তে ২০১৫ সালে এ হার বেড়ে হয়েছে ৬৭ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের শেষ দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ২৪ শতাংশ মানুষ বিপর্যয়মূলক ব্যয়ের মধ্যে পড়ছে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতি বছর ৬২ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে এবং প্রতি বছর প্রায় ১৬ শতাংশ রোগী প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ থেকে বিরত থাকছে।

এদিকে দেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যু আশঙ্কাজনকহারে বাড়লেও তা মোকাবিলায় বাড়েনি বরাদ্দ। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে গতকাল গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) আয়োজিত অসংক্রামক রোগ মোকাবিলায় বাজেট বরাদ্দ: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত শীর্ষক ওয়েবিনারে এ দাবি জানানো হয়।

গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই) সহযোগিতায় আয়োজিত এ ওয়েবিনারে জানানো হয়, সাধারণভাবে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত সোডিয়াম বা লবণ গ্রহণ, তামাকের ব্যবহার, কায়িক শ্রমের অভাব, বায়ুদূষণ প্রভৃতি কারণে দেশে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে, যা বর্তমানে দেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৭০ শতাংশ। এসব রোগ মোকাবিলায় বাজেট বরাদ্দ খুবই সামান্য মোট স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জাতীয় বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দিলেও, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে এ খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে কম।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, শুধু উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানোর মাধ্যমেই অসংক্রামক রোগের প্রকোপ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আসন্ন বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিতের পাশাপাশি জনগণের মধ্যে লবণ গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে।

জিএইচএআই বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মুহাম্মাদ রূহুল কুদ্দুস বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপের পরীক্ষা ও ওষুধের পেছনে ১ টাকা ব্যয় করলে সামগ্রিকভাবে ১৮ টাকার সুফল পাওয়া সম্ভব। কাজেই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এ খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি টেকসই অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শেখ হাসিনার সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে : শামা ওবায়েদ 

অভিজ্ঞতা ছাড়াই চাকরি দেবে রকমারি ডটকম, বেতন ৩০ হাজার

জীবিকার তাগিদে বের হয়ে প্রাণ হারালেন রফিকুল

হঠাৎ অসুস্থ একই স্কুলের ২২ ছাত্রী

কয়েকটি ইসলামি দলের সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে : সালাহউদ্দিন 

দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোয় পরিবহনমন্ত্রীকে জরিমানা!

নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে হামলাকারীদের কী সাজা হতে পারে

গকসু নির্বাচন : প্রথম দিনে ১৩টি মনোনয়নপত্র বিতরণ

ববির আবেগঘন পোস্ট

খুলনায় নদী থেকে বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার

১০

প্রয়োজনে কেয়ামত পর্যন্ত অডিট বন্ধ থাকবে : এনবিআর চেয়ারম্যান

১১

১ বলে ১৩ রান নিলেন ভারতের তারকা ওপেনার

১২

ডাকসু নির্বাচন / প্রচারণার প্রথম দিনই শিবিরের ব্যানার ভাঙচুর

১৩

হিজাব বিতর্কে ভিকারুননিসার সেই শিক্ষিকা বরখাস্ত

১৪

এই ৩ ভুল করছেন? শত চেষ্টাতেও কমবে না মেদ

১৫

একদিন পর ভেসে উঠল ইসমাইলের মরদেহ

১৬

বিশ্বে প্রথমবার মানব শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন

১৭

নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই : হাসনাত

১৮

ডাকসু নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থী ৪৭১

১৯

আমি বিবাহিত, ফেসবুকে প্রমাণ করার কিছু নেই : অপু

২০
X