রাফায় যে কারণে হেরে যাবেন নেতানিয়াহু
ইসরায়েলি সেনারা বারবারই বলছে, তারা গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় স্থল অভিযানের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এ খবর ইসরায়েলের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ইসরায়েলের হেয়োম পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির সেনাবাহিনী অভিযানের জন্য এখন কেবল রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। অ্যামেরিকাও রাফায় অভিযানের ব্যাপারে এরই মধ্যে সবুজ সংকেত দিয়েছে।
গাজার অন্য শহরগুলোর মতো রাফাও ঘন বসতিপূর্ণ। ছোট্ট শহরটিতে প্রায় ৩ লাখ মানুষ বসবাস করলেও বিভিন্ন স্থান থেকে ইসরায়েলি হামলায় বাস্তুচ্যুত আরও প্রায় ১৪ লাখ মানুষ উপকূলীয় এলাকাটিতে আশ্রয় নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর স্থল অভিযান পরিচালনা নিয়ে বিশ্বনেতারা উদ্বেগ জানাচ্ছেন। এর ফলে বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষের হতাহতের শঙ্কা তাদের।
তাদের উদ্বেগের মূলে রয়েছে, গত ২০০ দিনেরও বেশি ধরে সময় চলা যুদ্ধে গাজার অন্য শহরগুলোতে আইডিএফ সেনাদের হত্যাযজ্ঞ, বেসামরিক মানুষকে তোয়াক্কা না করা এবং তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা। আর একারণেই, বিশ্ব নেতারা, এমনকি ইসরায়েলের পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনও নেতানিয়াহুর কাছে রাফা অভিযানে বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষা এবং মানবিক সহায়তার ব্যাপারে নিশ্চয়তা চাইছেন। ওই অভিযানের পরিকল্পনা তাদের সামনে উপস্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
হিব্রু ভাষার অন্যতম শীর্ষ সংবাদমাধ্যম মারিভে রাফায় হামলার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামকে শেষ করে দেওয়া এবং বিনা চ্যালেঞ্জে ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্ত করা নিয়ে সংশয় জানানো হয়েছে। সংবাদমাধ্যমটিতে বলা হয়- ‘যারা ভাবছেন, রাফাই হবে এই যুদ্ধের শেষ অধ্যায় এবং এর মাধ্যমে হামাসকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হবে, তারা হয়তো অনুধাবন করতে পারছেন না, নেতানিয়াহুর বিজয়ের দাবি তামাশা এবং বিভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়।’
মারিভ আরও বলছে, নেতানিয়াহুর সেনারা পুরো গাজাকে দখল করলেও তার বাহিনীকে সেখান থেকে প্রত্যাহারের পরই হামাস পুনরায় সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অনেক ইসরায়েলি লেখক, সামরিক বিশেষজ্ঞ নেতানিয়াহুকে চড়া মূল্য দিয়ে হলেও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, লক্ষ্য অর্জনের এটিই একমাত্র উপায়।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নানা জটিলতার জন্য শেষ পর্যন্ত নেতানিয়াহুকে কারাগারেও যেতে হতে পারে। ইসরায়েলি নেতা হিসেবে তিনি তার দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের বিজয়ের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু তিনি এখনো জানেন না সেটি কীভাবে সম্ভবপর হবে। তার এই একগুয়েমি স্বভাবের জন্য তিনি অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের মিত্রদের কথাতেও কর্ণপাত করছেন না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার শীর্ষ কর্মকর্তা ও কংগ্রেসম্যানদের কথাও শুনছেন না নেতানিয়াহু। এমনকি, শাবাক (ইজরায়েলি নিরাপত্তা সংস্থা) এবং হামাসের সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্বদানকারী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ প্রধানসহ তার সামরিক উপদেষ্টাদের কারও কথাতেই সায় দিচ্ছেন না।
অন্যদিকে, নেতানিয়াহু রাফায় হামলা করবেন কী করবেন না, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তারা স্পষ্টতই বলছে, ইজরায়েলি বন্দি মুক্তির শর্তে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনা হবে না। হামাসসহ অন্য প্রতিরোধ সংগঠনগুলো প্রাণহানি কমানো বিশেষ করে বেসামরিক লোকজনের ওপর ইসরায়েলি হামলা প্রতিরোধের বিষয়টাতে প্রাধান্য দিচ্ছে। একইসঙ্গে তারা বলছে, ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি সাড়ে আট হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির মুক্তি এবং দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছর ধরে উন্মুক্ত কারাগারে বসবাসরত ২৪ লাখ গাজাবাসীর স্বাধীনতা পাওয়া তাদের অধিকার।
অতএব, এমন অনড় অবস্থান এবং ফিলিস্তিনিদের বৈধ প্রতিরোধ সংগ্রামের মুখে নেতানিয়াহু রাফায় হামলা করুক অথবা নাই-বা করুক, তার স্বপ্নের বিজয় অর্জিত হবে না।
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রামের পক্ষে বিশ্বজুড়ে সুস্পষ্টভাবেই সমর্থন বাড়ছে। একইসঙ্গে, নেতানিয়াহু এবং তার অব্যাহত অপরাধের প্রতিও ক্ষোভ বেড়েই চলেছে। কিন্তু নেতানিয়াহু তাদেরকে তোয়াক্কা করছেন না। তিনি বেশ কয়েকবার দাবি করেছেন যে, রাফা অভিযান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেছেন তিনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই তার ওই দাবিকে অস্বীকার করেছে।
অ্যামেরিকার ‘নিয়ার ইস্টার্ন অ্যাফেয়ার্সের’ অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি বারবারা লিফের কাছে রাফায় হামলার জন্য ইজরায়েলকে হোয়াইট হাউজের সবুজ সংকেত দেওয়ার বিষয়ে মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তাত্ক্ষণিক নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, ‘মোটেই নয়... আমি নিশ্চিত করতে পারব না যে, এমন কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। আমরা সামরিক অভিযানের বিষয়ে সবুজ সংকেত দেইনি।’
কিন্তু নেতানিয়াহু ক্রমাগতভাবে বলেই যাচ্ছেন যে, রাফায় হামলা চালিয়ে হামাসের সামরিক শাখাকে উপড়ে ফেলার মাধ্যমে ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য করা হবে। ফলে, এ চিন্তায় তিনি অ্যামেরিকাসহ পশ্চিমা মিত্র এবং মিশরের মতো আঞ্চলিক প্রতিবেশী মিত্রসহ গোটা বিশ্বের দাবিকে উপেক্ষা করে চলেছেন। তিনি যুদ্ধবিরতি চুক্তির সব প্রচেষ্টাকে অবজ্ঞা করে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কাছ থেকে ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্ত করা করার কথা বলে যাচ্ছেন।
ইসরায়েলের একটি সম্প্রচার মাধ্যম কেইন জানাচ্ছে, রাফায় হামলার হুমকির পাশাপাশি যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য আলোচনাও চালিয়ে যাওয়া হবে। ২০০ দিনের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ভয়াবহ নৃশংসতা চালানোর পরও নেতানিয়াহু গাজায় বন্দি ইসরায়েলিদের কীভাবে মুক্ত করবেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট পথ বের করতে পারেননি। অনেক ইসরায়েলির সঙ্গে তিনিও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামকে নির্মুলে সামরিক শক্তি প্রয়োগেই মনোযোগী। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই হাজারো বন্দিকে ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্ত করা এবং গাজায় ১৮ বছরের ইসরায়েলি অবরোধ অবসানের চেষ্টা চালাচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। যদিও নেতানিয়াহু এ ধারণাকে অবজ্ঞা করে যাচ্ছেন।
গত ২০০ দিন ধরে নেতানিয়াহু যুদ্ধের নামে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, হাজার হাজার শিশু হত্যা এবং ঘরবাড়ি, স্কুল, কলেজ ও মসজিদসহ সব ধরনের স্থাপনা ধ্বংস করেছেন। কিন্তু তিনি আজও তার বন্দিদের মুক্ত করতে পারেননি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কেবলমাত্র চুক্তির মধ্য দিয়েই তাকে ইসরায়েলিদের মুক্ত করতে হবে। ফিলিস্তিনি যোদ্ধারাও এ ব্যাপারে সম্মত। তারা গোটা দশেক ইসরায়েলিকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে যুদ্ধবিরতি এবং নারী ও শিশুসহ ফিলিস্তিনি বন্দিদের ইসরায়েলি জেল থেকে মুক্ত করতে চায়।
রাফায় হামলার অব্যাহত হুমকি-ধমকি এবং ভেতর ও বাইরে থেকে ইসরায়েলি কর্মকর্তা ও মিত্রদের বক্তব্যই প্রমাণ করে নেতানিয়াহু কতটা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন।
ইজরায়েলের উদারপন্থি ইহুদিবাদী দল বেতিনো’র প্রধান অ্যাভিগডর লিবারম্যান নেতানিয়াহুর রাফা অভিযান নিয়ে কটাক্ষ করে বলেন, ‘তিনি রাফায় হামলার ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এমন সিদ্ধান্ত নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। হয়তো, তারা হামাসকে হামলার সুনির্দিষ্ট সময় ও তারিখ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।’
মিডল ইস্ট মনিটর অবলম্বনে অনূদিত
০১ মে, ২০২৪