বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম আম্পায়ার / ‘এখানে বিখ্যাত হতে আসিনি’
দক্ষিণ আফ্রিকা-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ দিয়ে ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ফিল্ড আম্পায়ারিংয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকত। আজ ইংল্যান্ড-আফগানিস্তান ম্যাচে মাঠে আম্পায়ারিং করবেন তিনি। ভারতে যাওয়ার আগে আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারের শুরু, বাংলাদেশে এই পেশার চ্যালেঞ্জ—এসব নিয়ে কালবেলার স্পোর্টস রিপোর্টার
ওমর ফারুককে দেওয়া তার সাক্ষাৎকার...
কালবেলা: আম্পায়ারিংয়ের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
সৈকত: আমি একটা সময় জাতীয় দলের হয়ে খেলেছি, অনেকে হয়তো জানেন না। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়কও ছিলাম। ইচ্ছা ছিল বড় ক্রিকেটার হওয়ার, কিন্তু ১৯৯৪ বিশ্বকাপ কোয়ালিফাই খেলতে কেনিয়া যাওয়ার পর একটা ব্যাক ইনজুরি হয়েছিল। ’৯৭-এ যখন বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতল, সে দলে আমি ছিলাম না। তখন চিন্তা করলাম আমি ভিন্ন কিছু করতে পারি, যেটা দিয়ে ক্রিকেটের মধ্যেই থাকতে পারব। সেখান থেকেই আম্পায়ারিংয়ের চিন্তা। আমি তখনই চিন্তা করেছি, বাংলাদেশ যেহেতু বিশ্বকাপে খেলবে, তাহলে আম্পায়ারিং করার একটা সুযোগ আসতে পারে। ২০০০ সাল থেকেই আম্পায়ারিং শুরু করি। অনেক আগে থেকেই চিন্তা করছি। তখন মাথায় ছিল বাংলাদেশ হয়তো একদিন টেস্ট স্ট্যাটাস পাবে, আমিও টেস্ট আম্পায়ার হতে পারব। তারপর তো অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে এখন হয়তো সাফল্য দেখছি।
কালবেলা: আম্পায়ারিংয়ে মোটিভেশন পাওয়া?
সৈকত: একদিন ক্রিকেট বোর্ড থেকে আমায় বলা হলো, সকালে আবাহনী মাঠে যেতে হবে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ আছে। একজন আম্পায়ার অসুস্থ, তখন আমি আম্পায়ার্স ম্যানেজার। এটি একটি রেলিগেশন লিগের ম্যাচ ছিল, ওই খেলাটা আর শেষ হতে পারেনি (ঝামেলা হওয়ায়)। এটি আমার প্রিমিয়ার লিগের আম্পায়ার হিসেবে অভিষেক ম্যাচ ছিল। তখন আমি ভাবলাম, আমাকে যখন অভিষেকই করা হয়েছে, তাহলে আমার আম্পায়ারিংই করা উচিত। এরপর এক সময় আলিম দার (সাবেক আইসিসি এলিট প্যানেল আম্পায়ার) এসেছিলেন, তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার আম্পায়ার ছাড়ার প্রয়োজন নেই, নিয়মিত করে যাওয়া উচিত।’
কালবেলা: আম্পায়ারিংকে পেশা হিসেবে নেওয়া কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
সৈকত: একটা সময় আম্পায়ারিং ছেড়ে দেব ভাবছিলাম, তখন ক্রিকেট বোর্ডে ঢুকলাম। আম্পায়ার্স ম্যানেজার হলাম। তখন নিরপেক্ষতার কথা ভেবে আমি চিন্তা করলাম, আমার আম্পায়ারিং করা উচিত নয়। তার পরও আমাকে জোর করে আম্পায়ারিং করানো হয়েছে। তখন আমি চিন্তা করলাম, না এটিকে নিলে গুরুত্ব সহকারেই নিতে হবে। তারপর ২০১০-এ চাকরি ছাড়ার পর আমি আন্তর্জাতিক ম্যাচের আম্পায়ার হলাম। তারপর থেকে তো চলছে ১৩ বছর ধরে। আমি বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স ম্যানেজারের চাকরি ছেড়েছি। একটা সময় রবিতেও কাজ করেছিলাম, সেটিও ছেড়েছি। তখন চিন্তা করলাম, আমি আম্পায়ারিংই করব; এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমি এখানে বিখ্যাত হতে আসিনি, আমার সংসার চালাতেও আসিনি। আমি শুধু লোগো লাগাতে এ পেশায় আসিনি। আমি এটি শুধুই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। ওই চ্যালেঞ্জে আলহামদুলিল্লাহ মনে হয় পাস করেছি।
কালবেলা: ‘বিখ্যাত’ শব্দটা বললেন, আপনাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা না যাওয়ার কারণ?
সৈকত: আমি তো বিখ্যাত হয়েছিলাম ’৯৪ সালে যখন খেলি, তখনই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। এরপর এআইইউবিতে এমবিএ করেছি। পড়াশোনা করে যা না শিখেছি, আমি আম্পায়ারিং করতে এসে জীবনের যে পাঠ শিখছি, তা অন্যরকম। এখানে মানুষ অনেক সমালোচনা করে, পারসেপশন ডেভেলপমেন্ট করে। সব কিছুই আমাদের চাকরির সঙ্গে নিয়ে আসে। শুরুর দিকেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, এটি আসলে ফেসবুক নয়, ফেকবুক। আমরা যেভাবে গড়ে উঠেছি, আমরা তারকা হতে পারি না। মানুষ খেলা দেখতে আসে খেলোয়াড়দের, আমাদের না। কিন্তু আম্পায়ারিং যে অনেক কঠিন চাকরি, এটি মানুষ বোঝে না। আম্পায়ারদের সব সময় লো প্রোফাইল মেইনটেইন করতে বলছে। আপনি দেখাতে পারবেন না যে, আমি স্টার। টিকিট কেটে মানুষ খেলা দেখতে আসবে আম্পায়ারকে না। আর আম্পায়ারিং ফেসবুক দিয়ে হয় না। আমার লক্ষ্যটা বড় ছিল, সে কারণে আমি ফেসবুকে না। আমি কখনো বাস্তব দুনিয়া থেকে বিচ্যুত হতে চাইনি, সে কারণে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় যাইনি।
কালবেলা: আম্পায়ারিং নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ কীভাবে দেখেন?
সৈকত: আমাদের দেশে আম্পায়ারিং নিয়ে মানুষের ধারণা খুব কম। তারা মনে করে, আউট আর নকআউট সিদ্ধান্তই আম্পায়ারিংয়ে সীমাবদ্ধ। ব্যাপারটা আসলে সেরকম নয়। আম্পায়ারিংয়ে মাত্র ৪২টা ল। তারপরও আমরা ভুল করি, ২০ বছর ধরে একই ল পড়ছি, তারপরও পরিস্থিতিতে গিয়ে আমাদের ভুল হয়। কতটা কঠিন আর চ্যালেঞ্জিং হলে এমন হতে পারে, চিন্তাও করতে পারবেন না। মানুষ বলে পাড়ার ক্রিকেটে নাকি এরকম আম্পায়ার পাওয়া যায়, তাহলে উনারা কই। এটি যে কতটা চাপ, আপনি হয়তো টিকতেও পারবেন না। আমি এসব কারণে বাইরের বিষয়গুলোতে প্রভাবিত হই না। মানুষ না বুঝেই তুলনা করে উনি ভালো, উনি খারাপ; এমন পর্যবেক্ষণ নিয়ে আমি চিন্তিত নই। মানুষ আলিম দারকেও তো নানাভাবে গালি দেয়; কিন্তু তার সাফল্যের জন্য তাকে তো হাজার বছরেও কেউ ছুঁতে পারবে না।
কালবেলা: এবার বিশ্বকাপ আম্পায়ারিং প্রসঙ্গে আসি। আপনার কি মনে হয় না এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট আরও আগেই আসা উচিত ছিল?
সৈকত: আমারও তা-ই মনে হয়। কারণ, আমরা সাত নম্বর বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছি। এই জায়গায় নিশ্চয়ই আমরা ওইভাবে দৃষ্টি দিইনি বলেই আমরা এ পর্যন্ত আসতে পারিনি। আমরা সব সময় ক্রিকেট কালচার নিয়ে কথা বলি, সেটিও শুধু খেলোয়াড়দের বিষয়াদির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি। এর বাইরে কিন্তু আমরা আসলে যেতে পারি না। আম্পায়ারিং যে একটা সেক্টর, এটির মাধ্যমেও যে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিজেদের উজ্জ্বল করতে পারি, ওইভাবে আমরা কখনো চিন্তা করিনি বলেই এত পরে এসেছে। আম্পায়ার কিন্তু ট্রেনিং দিয়ে হয় না, এটি একটি প্রসেসের মাধ্যমেই হয়।
কালবেলা: এখান থেকে কতদূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন?
সৈকত: একটা সময় শুনতাম, দশ বছর ধরে আমি একই জায়গায় আটকে আছি। কথা বিশ্বাসও করতে শুরু করেছিলাম, তবে কখনো ভেঙে পড়িনি, আত্মবিশ্বাস হারাইনি। একটা সময় মনে হয়েছিল আমি বোধহয় টেস্ট ম্যাচ কখনো পাব না। কারণ, আমার সামনেই অনেক আম্পায়ারকে টেস্ট অভিষেক করতে দেখেছি বাংলাদেশে এসে। আমি ফোর্থ আম্পায়ার ছিলাম, অনেকের তখন ডেব্যু হতো এখানে। কিন্তু আমি মনোবল হারাইনি। কারণ, আমি জানতাম যে যাদের অভিষেক হচ্ছে, তাদের চেয়ে আমি পিছিয়ে নেই। একটা সময় টেস্ট ম্যাচ হলো, এখন বিশ্বকাপও এলো। বাকি পূর্ণতা হলো যদি হয়তো এলিট আম্পায়ার হতে পারি। হতেই হবে এমন না, কিন্তু একটা মানুষ যতটুকু চাইতে পারে, ততটুকু চাওয়া। এরপরও জায়গা আছে, সে পথটুকু পার হওয়া খুব কঠিন।
কালবেলা: আম্পায়ারদের উন্নতির জন্য আপনার চাওয়া?
সৈকত: আমি চাই একটা সুন্দর কাঠামো। মেরিট বেজ আম্পায়ারিং সিস্টেম, সহজ না। চাপমুক্ত আম্পায়ারিং সিস্টেম ও আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাতে ভালো ছেলেরাও ওপরের দিকে আসতে পারে, এখানে হবে কী সব আম্পায়ারই বুঝে যাবে, সে আসলে কেমন, কত উপরে আসতে পারবে কিংবা পারবে না। সিস্টেমে সুন্দরভাবে কাজ করতে সবাই সবার অবস্থান বুঝতে পারবে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির কোনো প্যানেল নেই, যেটি সব দেশে আছে। যেখানে টেস্ট ম্যাচের গুরুত্ব বেশি, সেখানে কিন্তুটাও আছে।
১৫ অক্টোবর, ২০২৩