মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৩:১০ এএম
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:১১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বেনামি কোম্পানির যন্ত্রে বিখ্যাত ব্র্যান্ডের স্টিকার!

স্বাস্থ্য খাতে মিঠু সিন্ডিকেট
বেনামি কোম্পানির যন্ত্রে বিখ্যাত ব্র্যান্ডের স্টিকার!

সরকারি হাসপাতালকে বলা হয় গরিবের চিকিৎসাকেন্দ্র। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। এসব প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু সরবরাহ করেছেন বিখ্যাত ব্র্যান্ডের ভুয়া স্টিকার লাগানো মানহীন যন্ত্রপাতি। কার্যাদেশের বিপরীতে কখনো বা দিয়েছেন রিকন্ডিশন (পুরোনো) মেডিকেল সামগ্রী। কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ডেনমার্ক ও জাপানের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের ভুয়া স্টিকার লাগানো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) বেড, অপারেশন থিয়েটারের যন্ত্রপাতি, ফ্রিজার, এনালাইজারসহ বিভিন্ন মানহীন পণ্য সরবরাহ করেছে মিঠু চক্র। এতে একদিকে সরকারি টাকা লুটপাট করেছে। অন্যদিকে, রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভুল ফল আসছে। ফলে আস্থা সংকটে পড়ছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসকদের সেবা নিয়েও আঙুল তুলছেন রোগী ও তার স্বজনরা। ভুল চিকিৎসার অজুহাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। এসব ভুলের মূলে রয়েছে হাসপাতালের যন্ত্রপাতির মান। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মোতাজ্জেরুল ইসলাম (মিঠু) দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুর, বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আইএসটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের ভুয়া স্টিকার লাগানো/নিম্নমানের রিকন্ডিশন মেশিন সরবরাহের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎসহ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে মোতাজ্জেরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

বাধ্য হয়ে সাধারণ মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে ছুটছেন বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে। অনেকে শেষ সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর দেশের অন্তত প্রায় ২০ লাখ রোগী ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে রোগীদের চিকিৎসা গ্রহণের নেপথ্যে ভুল ডায়াগনসিস। আর ভুল ডায়াগনসিসের নেপথ্যে ভুয়া স্টিকার লাগানো নিম্নমানের যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়টা শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের ওপর পড়ে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, মানুষের রোগ নির্ণয়ের মূল উপাদান আধুনিক যন্ত্রপাতি। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রোগ নির্ণয়ের পর চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র লেখেন। রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি যদি ভুয়া হয়, চিকিৎসক কীভাবে সঠিক চিকিৎসা দেবেন! ভুল চিকিৎসার পথ তৈরি হয়। ভুল রিপোর্টে ওষুধ লিখলে রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটে। রোগ না সারলে আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তখন চিকিৎসকের ওপর রোগীর আস্থা সংকট তৈরি হয়। এতে একদিকে যেমন রোগীর শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতি হয়, অন্যদিকে চিকিৎসকের দুর্নাম হয়। ভুল ডায়াগনসিসের কারণে রোগী এবং রোগীর পরিবারকে পদে পদে হয়রানি হতে হয়। কখনো বা রোগীর মৃত্যুও হয়।

কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে মিঠুচক্র জাপানের ইয়োংগটাই ব্র্যান্ডের এলসি-১০০ মডেলের লো স্প্রিড সেন্ট্রিফিউজ (১২ হোল), এলসি ১০ সি মডেলের লো স্প্রিড সেন্ট্রিফিউজ (১২ হোল), কেডিসি ৪০ মডেলের লো স্প্রিড সেন্ট্রিফিউজ (২৪ হোল), টিজিএল ১৬ মডেলের রেফ্রিজারেটেড সেন্ট্রিফিউজ মেশিন, এলসি ১০০ মডেলের লো স্প্রিড সেন্ট্রিফিউজ (১২ হোল), জাপানের কেডিসি ৪০ মডেলের লো স্প্রিড সেন্ট্রিফিউজ (২৪ হোল), জাপানের ফিজিওমেড ব্র্যান্ডের ফিজিওপ্লাস মডেলের শর্ট ওয়েব থেরাপি মেশিন সরবরাহ করেন। কিন্তু জাপানে এসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। ভুয়া স্টিকার লাগিয়ে এসব সরবরাহ করা হয়।

জার্মানির হাইয়ার ব্র্যান্ডের ডিএস ২ মডেলের ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর (ডাবল ডোর), এইচওয়াইসি-৯৪০ মডেলের ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর (স্টান্ডার্ড ফর রিসেন্ট প্রিজার্ভেশন), এইচওয়াইসি-৩৬০ মডেলের ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর (স্টান্ডার্ড ফর রিসেন্ট প্রিজার্ভেশন), ব্র্যান্ডের এইচবিডি ২৮৬ মডেলের ভ্যাকসিন অ্যান্ড আইস প্যাক ফ্রিজার, এইচএক্সসি ১৫৮/৩৫৮ মডেলের ব্লাডব্যাংক রেফ্রিজারেটর, এইচওয়াইসি-৩৬০ মডেলের ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটার, এইচবিডি ২৮৬ মডেলের ভ্যাকসিন অ্যান্ড লিও প্যাক ফ্রিজার-২৫সি, এইচওয়াইসি-৩৬০ ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর, এইচওয়াইসি-৯৪০ মডেলের ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর (ডাবল ডোর), জার্মানির শিনভ্যা ব্র্যান্ডের এসএক্সটিআই৫০০এফজেডকিউ/এস এক্সটি ৩০০এফডিকিউ হেভি ডার্টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়াশিং মেশিন (ক্লথ), এমএসডি.বি মডেলের স্টালাইজার ভ্যাকুম টাইপ, ডেভিড ব্র্যান্ডের এইচকেএন ৯০১০ মডেলের রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার, ডিরুই ব্র্যান্ডের এইচ ৫০০ মডেলের সেমি অটোমেটেড ইউরিন কেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার ও আইএমএস ব্র্যান্ডের আইএমএস৯৭২এ মডেলের ইলেকট্রোলাইট অ্যানালাইজার। এ ছাড়া জার্মানির এইচসিবি-০৪এলওয়াই মডেলের গাইনোকোলজি বিভাগের টেবিল, এইচসিবি-০৪এলওয়াই মডেলের টেবিল ফর গাইনোকোলজি সরবরাহ করা হয়। অথচ জার্মানিতে এসব কোম্পানির অস্তিত্ব নেই।

আবার ডেনমার্কের লিনাক ব্র্যান্ডের আরএস ১০১ মডেলের আইসিইউ বেড, আরএস ১০১ মডেলের প্রেশেন্ট এক্সামিনেশ বেড স্টান্ডার্ড, আরএস ১০১ মডেলের আইসিইউ বেড, ডিএস-২ মডেলের অপারেটিং টেবিল আই, ডিএস ২ মডেলের অপারেটিং টেবিল আই, আরএস ১০১ মডেলের প্রেশেন্ট এক্সামিনেশন বেড সরবরাহ করা হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জার্মানিতে এ ব্র্যান্ডের অস্তিত্ব নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেরি ব্র্যান্ডের জেরি-এইচপ্লাস মডেলের পালস অক্সিমিটার, এক্সসি-এ৩০০ মডেলের অটোমেটেড ইএসআর অ্যানালাইজার এবং যুক্তরাজ্যের ড্রাগন ব্র্যান্ডের ডি ৩০২৪ মডেলের হাই স্প্রিড মাইক্রো সেন্ট্রিফিউজ, ডি ৩০২৪ মডেলের হাই স্প্রিড মাইক্রো সেনট্রিফিউজ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এসব ব্র্যান্ডের অস্তিত্ব যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পাওয়া যায়নি।

এখানেই শেষ নয়, ২০১৬ সালের ২৯ মে রংপুর সিভিল সার্জন অফিসে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নামে ১৮৪৫/৭ স্মারকের এক টেন্ডারে ২৪ কোটি ৮৮ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯০ টাকার কার্যাদেশ পাওয়ার পরদিন (২০১৬ সালের ৩০ মে) ভুয়া বিল চালান দাখিল করে বিল তুলে নেওয়া হয়। একইভাবে একই টেন্ডারে আরও এক কার্যাদেশে ১৭ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার টাকার ভুয়া বিল চালান দাখিল করে বিল তুলে নেয় মিঠু চক্র। একই টেন্ডারে এক খাতে দুই দফায় মোট ৪২ কোটি ৪৪ লাখ ২৫ হাজার ২৯০ টাকার বিল তুলে আত্মসাৎ করে। একটি সিভিল সার্জন কার্যালয়ে কীভাবে এত টাকার যন্ত্রপাতি লাগে, তা নিয়ে বিস্মিত স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্টরা।

জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ডা. ফয়জুল হাকিম কালবেলাকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা খাতে কেনাকাটার নামে সবচেয়ে বড় পুকুর চুরির ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে ঘটেছে। এ চক্রের হাত ধরে অপ্রয়োজনীয়, অপ্রচল, ভুয়া স্টিকারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে সরকারি হাসপাতাল সয়লাব। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদার, দুর্নীতিবাজ কেনাকাটা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও লুটেরা রাজনীতিবিদরা দায় এড়াতে পারেন না। মিঠু স্বাস্থ্য খাতে অতীতের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। তবু তার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এখন সময় এসেছে গরিবের চিকিৎসা খাতে কেনাকাটার নামে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিরপুরে শিক্ষার্থীদের মাঝে নেইবারসের স্কুলব্যাগ ও খাদ্য বিতরণ

চুরির অপবাদে মারধর, ক্ষত স্থানে ছিটানো হয় লবণ-মরিচের গুঁড়া

গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের নতুন সমন্বয়ক ডা. সামছুল আলম

বিএনপি সকলকে নিয়ে ‘রেইনবো নেশন’ গড়বে : প্রিন্স

বাংলাদেশের ‘তীব্র নিন্দা’ জানিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পোস্ট

এসআইবিএল থেকে চাকরিচ্যুত পটিয়ার ৫৭৯ কর্মকর্তা

সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী উবায়দুল মোকতাদির গ্রেপ্তার

জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা সাজ্জাদ রশিদের পদত্যাগ

সংশোধন হচ্ছে ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন ১৯৮৯’

পরাজিত শক্তি আর ফিরতে পারবে না : নিতাই রায়

১০

উপজেলা যুবলীগের সাবেক নেতা হিরু গ্রেপ্তার

১১

নাশকতার মামলায় আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

১২

‘আবু সাঈদের ফরেনসিক প্রতিবেদন জোর করে ৬ বার পরিবর্তন করা হয়’

১৩

আগামী জুনের মধ্যে নির্বাচন দাবি বাংলাদেশ এলডিপির

১৪

পানিতে ডুবে যমজ ভাইয়ের মৃত্যু

১৫

যুব মহিলা লীগ নেত্রী লাকীর লাশ উদ্ধার

১৬

ইঁদুরের ওষুধ সেবন / রোহিঙ্গা শিবিরে এনজিও কর্মীর মৃত্যু

১৭

‘সবাই মিলে বৈষম্যহীন ও পরিবেশবান্ধব সমাজ গড়তে হবে’

১৮

সহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি : মোনায়েম মুন্না

১৯

‘অন্যায় দুর্নীতি হবে যেখানে প্রতিরোধ হবে সেখানে’

২০
X