মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন শিবলী সাদিক। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) স্কুলের এ বিভাগ থেকে মাধ্যমিক (এসএসসি) পাস করেন। এরপর ২০০০ ও ২০০১ সালে দুবার উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষা দিলেও উত্তীর্ণ হতে পারেননি; কিন্তু সেখানে দমে যাননি তিনি। প্যারামেডিক ডিপ্লোমা ডিগ্রি নিয়ে বনে যান চিকিৎসক। এরপর দাবি করেন, চীনের বেইহুয়া ইউনিভার্সিটির জিলিন মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। সেই ভুয়া সনদে বাগিয়ে নেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধন ও চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সদস্যপদ। এরপর গাজীপুরে কাশিমপুর ডক্টরস হাসপাতাল বানিয়ে নামেন চিকিৎসা নামের ব্যবসায়। সেখানে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে পাঁচতলা বাড়ি, দামি গাড়ি, হাসপাতালসহ গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ।
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল; কিন্তু বিপত্তি ঘটে গেল বছরের জানুয়ারিতে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে ধরা পড়ে ভুয়া সনদধারী একদল চিকিৎসক। তাদের সূত্র ধরেই শিবলীকে নিজ হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিছুদিন কারাবাসের পর জামিনে বেরিয়ে আসেন। সঙ্গে সঙ্গেই ফেরেন পুরোনো পেশায়। এখনো নিজের হাসপাতালে চিকিৎসার নামে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন শিবলী। গত মঙ্গলবার বিকেলে কাশিমপুর ডক্টরস হাসপাতালে গিয়ে জানা যায়, সেদিনও রোগী দেখেছেন তিনি।
সরেজমিন দেখা যায়, গাজীপুরের কাশিমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলে জিতার মোড়। আশপাশে অগণিত তৈরি পোশাক কারখানা। এসব কারখানায় কাজ করা স্বল্প শিক্ষিত ও নিম্ন আয়ের মানুষ ঘিরেই গড়ে উঠেছে কাশিমপুর ডক্টরস হাসপাতাল। সেখানে নিয়মিত রোগী দেখেন শিবলী। পরিচয় দেন মেডিসিন ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে।
গত ২১ আগস্ট রোগী দেখে তার দেওয়া একটি ব্যবস্থাপত্র এসেছে কালবেলার হাতে। সেখানে উল্লেখ করা, এমবিবিএস করেছেন ঢাকা থেকে! অথচ তিনি নিজেই দাবি করেন চীনের বেইহুয়া ইউনিভার্সিটির জিলিন মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। পিজিটি (মেডিসিন ও পেডিয়াট্রিক), এমডি ইন কোর্স করেছেন চীন থেকে। ডিএমইউডি (কনসালট্যান্ট সনোলজিস্ট) সিসিডি করেছেন বারডেম হাসপাতাল থেকে।
বিএমএর সদস্য বলেও এতে উল্লেখ আছে। ব্যবস্থাপত্রে উল্লিখিত বিএমডিসি নিবন্ধন নম্বর ৭৩৩২৬।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্যারামেডিকেল কোর্স আর বিদেশি ভুয়া সনদে চিকিৎসক বনে যাওয়া শিবলী সাদিক ছয় থেকে সাতজন নিয়ে কাশিমপুরের ওই এলাকায় দুই তলা ভবনে ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন। এর চেয়ারম্যানও তিনি। রোগী দেখার টাকায় এখন চড়েন টয়োটা প্রিমিয়ো গাড়িতে। সাভারের পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় বানিয়েছেন পাঁচতলা বাড়ি। এ ছাড়া আছে কৃষিজমি ও বিপুল সম্পদ।
দুদক সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ১৯ জানুয়ারি এমবিবিএস পাসের ভুয়া সনদ ব্যবহার করে চিকিৎসক হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নেওয়া সাত চিকিৎসককে রাজধানীর সেগুনবাগিচা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের সূত্র ধরেই ২৯ জানুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর ডক্টরস হাসপাতালে অভিযান চালায় সংস্থার উপপরিচালক সেলিনা আখতার মনির নেতৃত্বে একটি টিম। গ্রেপ্তার করা হয় হাসপাতালের চেয়ারম্যান শিবলী সাদিককে। এর আগে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর ভুয়া ১২ চিকিৎসক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রারসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল দুদক। ওই মামলায়ও শিবলী সাদিককে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেইহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জিলিন মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির যোগ্যতায় প্রথম শর্তে বলা হয়েছে, আবেদনকারীকে অবশ্যই অতীতের পাঠ্যক্রমে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যাসহ সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যাথমেটিকস (এসটিইএম) পড়ে আসতে হবে; কিন্তু শিবলী সাদিক বিকেএসপি স্কুল থেকে মানবিকে এসএসসি পাস করেন। এরপর তিনি আর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেননি।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ২০১০-এর ২৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে নিবন্ধন করা কোনো মেডিকেল চিকিৎসক বা ডেন্টাল চিকিৎসক এমন কোনো নাম, পদবি, বিবরণ বা প্রতীক ব্যবহার বা প্রকাশ করবেন না, যার ফলে তার কোনো অতিরিক্ত পেশাগত যোগ্যতা আছে বলে মনে করতে পারে, যদি না তা কোনো স্বীকৃত মেডিকেল চিকিৎসা-শিক্ষা যোগ্যতা বা স্বীকৃত ডেন্টাল চিকিৎসা-শিক্ষা যোগ্যতা হয়। ন্যূনতম এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রিপ্রাপ্তরা ছাড়া অন্য কেউ তাদের নামের আগে ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না। তবে অভিযোগে রয়েছে, ভুয়া চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএমডিসির ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে। কেননা, তাদের সম্পৃক্ততা না থাকলে সবার চোখের সামনে চিকিৎসাসেবার মতো সংবেদনশীল কর্মকাণ্ড অবৈধভাবে পরিচালনা সম্ভব নয়।
আইনের উপধারা (২)-এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)-এর বিধান লঙ্ঘন করলে ওই লঙ্ঘন হবে একটি অপরাধ এবং সেজন্য তিনি ৩ (তিন) বছর কারাদণ্ড বা ১ (এক) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সেই অপরাধ অব্যাহত থাকলে প্রতিবার তার পুনরাবৃত্তির জন্য ন্যূনতম ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বর্ণিত দণ্ডের অতিরিক্ত হিসেবে দণ্ডিত হবেন। সেই হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্রে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে কিংবা বিএমডিসি সনদ ছাড়া চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া অবৈধ ও বেআইনি। এজন্য শাস্তিরও ব্যবস্থা রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে শিবলী সাদিক কালবেলাকে বলেন, আমার ব্যাকগ্রাউন্ড আটর্স ছিল। বেহুয়া মেডিকেল কলেজ থেকে প্রি-মেডিকেল কোর্স করেছিলাম। এরপর ২০০৮-০৯ সেশনে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হই। ২০১৪ সালে এমবিবিএস পাস করেছি। সেখানে পড়াশোনা করে এসে বিএমডিসিতে পরীক্ষা দিয়ে নিবন্ধন নিয়েছি। বিএমডিসি সেটা অ্যাপ্রুভ করেছে। তারা আমার সনদের সত্যতা তিন থেকে চারবার ভেরিফাই করেছে। এর পরও দুদকের ঝামেলার কারণে বিএমডিসি সনদ টেম্পোরারি হোল্ড করেছে। এ নিয়ে আমি একটা আবেদন জমা দিয়েছি। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে দ্রুত সনদ ঠিক করে দেবে। এ সময় তিনি বিএমডিসির নিবন্ধন ফিরে পেতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বরাবরও আবেদন করেছেন বলে দাবি করেন। তবে সেই আবেদনের কপি দেখতে চাইলে এতে অপারগতা জানান তিনি। এ ছাড়া চীনের তাইশান মেডিকেলের এমবিবিএসের ভুয়া সনদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেন।
গাজীপুর জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. খায়রুজ্জামান বলেন, ভুয়া চিকিৎসক কিংবা হাসপাতালের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করি। শিবলী সাদিক ভুয়া চিকিৎসক হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিএমডিসির শৃঙ্খলা কমিটির চেয়ারম্যান ও বিএমএর মহাসচিব এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, প্রি-মেডিকেল বলে কোনো কোর্সের অস্তিত্ব নেই। প্যারামেডিক কোর্স বিজ্ঞান-মানবিক যে কোনো বিভাগের শিক্ষার্থীরা করতে পারেন। তবে এ কোর্স করেও এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির কিংবা চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে কেউ এমবিবিএস চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই তার সনদ ভুয়া।
এ প্রসঙ্গে বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. লিয়াকত হোসেন বলেন, মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাস করে কোনোভাবেই এমবিবিএস পড়ার সুযোগ নেই। প্রি-মেডিকেল করেও এমবিবিএস করার সুযোগ নেই। শিবলী সাদিকের বিষয়ে তিনি বলেন, দুদক গত বছর তাকে ভুয়া চিকিৎসক হিসেবে গ্রেপ্তার করেছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিএমডিসির নিবন্ধন সনদ স্থগিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। এর পরও তিনি চিকিৎসাসেবা দিয়ে গেলে সেটা নিয়মবহির্ভূত। তার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মন্তব্য করুন