কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৫, ০৫:২৩ পিএম
আপডেট : ২৬ জুন ২০২৫, ০৫:২৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

তুষারের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে যা লিখেছেন নীলা

নীলা ইসরাফিল। ছবি : সংগৃহীত
নীলা ইসরাফিল। ছবি : সংগৃহীত

অনৈতিক প্রস্তাবের অভিযোগে এবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তদন্ত কমিটি বরাবর অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন এনসিপির সাবেক সদস্য নীলা ইসরাফিল। অভিযোগপত্রের তিনি উল্লেখ করেছেন যে কীভাবে এনসিপি নেতা তুষারের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) একটি কপি ফেসবুকে নিজের আইডিতে পোস্ট করেছেন। নীলার অভিযোগপত্রটি হুবহু তুলে ধরা হলো౼

তারিখ : ২৬ জুন ২০২৫

অভিযোগপত্র

প্রেরক : নীলা ইসরাফিল

পদবি : সদস্য জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ও ধানমন্ডি থানার প্রতিনিধি (৫১), জাতীয় নাগরিক কমিটি

প্রাপক : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তদন্ত কমিটি

কপি : নাহিদ ইসলাম, আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি

আখতার হোসেন, সদস্য সচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টি

তারিখ: ২৬ জুন ২০২৫

বিষয় : এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক (স্থগিত) সারোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে অনৈতিক, যৌন হয়রানী ও শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ।

প্রিয় তদন্ত কমিটির সদস্যবৃন্দ, আমি, নীলা ইসরাফিল, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একজন নিবেদিতপ্রাণ, আদর্শনিষ্ঠ এবং মেধাবী কর্মী হিসেবে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য হিসাবে শুরু করে, বর্তমানে জাতীয় নাগরিক দলের নীতিগত লড়াই, আন্দোলন ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছি। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আমার কাছে কোনো লোভ বা পদ-পদবির বিষয় নয়; এটি আমার নৈতিক ও আদর্শিক বেছে নেওয়া পথ, একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন।

আমার উত্থাপিত অভিযোগ আমি অত্যন্ত সাহস এবং একইসাথে দুঃখ, এবং মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে করছি, শুধুমাত্র নিজের সম্মানরক্ষার জন্য নয়, বরং সংগঠনের নারী সদস্যদের জন্য একটি নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিসর প্রতিষ্ঠার আশায়।

প্রেক্ষাপট ও আমার অবস্থান:

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আমি এক নির্মম সহিংসতার শিকার হই, আমার প্রাক্তন স্বামী মোয়াজ আরিফ ঢাকা ক্লাবে আমাকে হত্যার চেষ্টা করে, যদিও নিপীড়ন-নির্যাতন এবং যৌন হয়রানী বিবাহ বিচ্ছেদের পরে কয়েক বছর ধরে চলছিল। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য অপব্যবহার করে আমাকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। এই ঘটনায় আমি শারীরিক, মানসিক এবং সাংগঠনিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হই। শারীরিক ও মানসিক, সুরক্ষার স্বার্থে আমাকে বাংলাদেশ ত্যাগ করে নেপালে যেতে হয়।

এই সময়টিতে সারোয়ার তুষার ছিলেন অনেকের মত আমার সঙ্গে যোগাযোগে থাকা রাজনৈতিক সহকর্মী, যিনি পূর্বেও আহত অবস্থায় অনেকের মত মানবিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন। সেই আস্থার জায়গা থেকেই আমি তার সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ চালিয়ে যাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পর্ককে তিনি ব্যক্তিগত ও অনৈতিক রূপ, যৌন হয়রানি করতে উদ্যত হন।

সুনির্দিষ্ট অনৈতিক আচরণসমূহ:

১. নৈশকালীন ব্যক্তিগত ও আপত্তিকর আলাপ:

তিনি প্রায়ই রাতের বেলা কল করে বলেন, ‘রাজনীতি নিয়ে কথা ভালো লাগে না, তোমার কণ্ঠে ভালো লাগে প্রতিবাদের স্লোগান’, ‘তোমার ঠোঁট সুন্দর’, ‘একটা সুন্দর ছবি পাঠাও’ এই ধরনের মন্তব্য বারবার আমাকে অস্বস্তি ও অপমানের মধ্যে ফেলেছে।

২. ভিডিও কলে কথা বলার চাপ ও ব্যক্তিগত ছবি চাওয়া:

আমি বারংবার অনুরোধ করেছি পেশাদার সীমা রক্ষা করতে। এরপরও তিনি বারবার ব্যক্তিগত আলাপের দিকে আলোকপাত করেন। ছবি চাইতেন এবং ভিডিও কলে কথা বলতে চাইতেন।

৩. ডিবি অফিসারের কাছে আমার সম্পর্কে মিথ্যা দাবি:

তিনি বলেন, “তোমার বিষয়ে ডিবি অফিসার আমাকে প্রশ্ন করলে আমি বলেছি, তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড।” একজন রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে এ ধরনের ভ্রান্ত তথ্য প্রদান চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং আমার সামাজিক মর্যাদাকে হেয় করার শামিল।

৪. ফোনালাপ রেকর্ড ও প্রচারের ঘটনা:

আমি যখন বুঝতে পারি, এই রাজনৈতিক সম্পর্ক আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ও মানসিকভাবে নিঃশেষ করছে, তখন ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে তুষারের সঙ্গে কয়েকটি ফোনালাপ রেকর্ড করি। ১৬ জুন সেই রেকর্ডের একটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তুষার আমাকে চাপ দিতে থাকেন যেন আমি ফেসবুকে বলি, “তার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।” আমি তখন দ্বিতীয় ও তৃতীয় ফোনালাপও রেকর্ড করি এবং এগুলো কিছু মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকের মাধ্যমে প্রচারে সম্মতি দিই। কেননা, সেইগুলো উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন হয়রানিমূলক, এবং যৌন হয়রানিমূলক অপরাধ করে তা প্রকাশ করা থেকে বিরত করবার চেষ্টাও হয়েছিল অবিরত।

দলীয় পদক্ষেপের অভাব ও হতাশা:

৭ জুন ২০২৫, ঈদের রাতে আমি বিষয়টি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জানাই এবং তুষারের দেয়া আপত্তিকর ম্যাসেজগুলো দেখাই। ওনার পরামর্শে ১৫ জুন (ঈদের ছুটির কারণে সব বন্ধ থাকায়) আমি মহানগর প্রতিনিধিদের শাহরিয়ার ও নিজামকে বিষয়টি জানাই। এখানে বলে রাখা ভাল, দুইজন পুরুষ সহকর্মী নিকট এই বিষয়ে আলাপ করতে অস্বস্তি বোধ করি, যার ফলে পরে আমি জ্যেষ্ঠ আহ্বায়ক সামান্তা শারমীনকেও বিষয়টি জানাই।

১৬ জুন রেকর্ডটি সোশ্যাল মিডিয়ার ছড়িয়ে পড়লে আমি আবার এনসিপির প্রধান কার্যালয়ে যাই বিষয়টি নিয়ে কথা বলে সাংগঠনিকভাবে নিষ্পত্তি করার জন্য। কিন্তু কারো কাছ থেকে তেমন কোন সাড়া না পেয়ে রাতে বাসায় ফিরে আসি।

আমার এই কঠিন সময়ে দলের পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো লিখিত বিবৃতি, সহানুভূতি বা সুরক্ষা প্রদান করা হয়নি। ১৯ জুন এনসিপির পক্ষ থেকে আমাকে লিখিত অভিযোগ জমা দিতে বলা হয়। এছাড়া সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্বশীল বা আন্তরিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি; এই ধরনের নীরবতা, গা-ছাড়া আচরণ, এবং একটি নারীর সম্মান নিয়ে কৌশলগত নিঃস্পৃহতা একটি প্রগতিশীল দলের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

একই সাথে, আমি বলতে চাই, রাজনীতিতে একজন নারী হিসেবে পথ চলাটা সহজ নয়, শিল্পী হিসাবেও বুঝেছি অনেক আগেই । কিন্তু সত্য বলার পর, দলের ভেতরে যে ভয়াবহ মানসিক নিপীড়নের মুখে পড়তে হবে, সেটা কল্পনাও করিনি। আপনারা মনে করতে পারেন, আমার লিখা এবং তুষারের সাথে রেকর্ডিং ছড়িয়ে মব করতে চেয়েছি, ভুল আপনারা, আমার লিখা এবং তুষারের সাথে রেকর্ডিং তুষারের অপরাধের প্রমাণ।

আপনারা জেনে অবাক হবেন, তুষারের বিপক্ষে অভিযোগ জানানোর পরে; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- ফেসবুক, WhatsApp এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে গ্রুপে শুরু হয়ে গেল উশৃঙ্খল জনতার বিশৃঙ্খলা (মব ট্রায়াল) দলবদ্ধভাবে নিন্দা, অপপ্রচার, চরিত্রহননের চেষ্টা। এই কোনো আইনি প্রক্রিয়া নয়। এটা এক ধরণের ডিজিটাল লিঞ্চিং।

আপনাদের জেনে রাখা ভালো, কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে "মত তৈরি" করছেন, গুজব ছড়াচ্ছেন, এবং আমার সম্মান এবং আত্মমর্যাদাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আপনারা এই বিষয়ে অবগত নন? কোন ব্যবস্থা কি নিয়েছেন? কোন কর্মী যদি এই ভুক্তভোগীকে অপরাধিকরণ করে কোন নীতিমালা আছে? এটাই কি আপনাদের দলীয় চেতনা এবং নৈতিকতা, যার কথা বলে আমরা জনগণের সামনে দাঁড়াই?

আমার স্পষ্ট দাবি ও প্রত্যাশা:

১. একটি নিরপেক্ষ, নারীবান্ধব এবং স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে সারোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে যথাযথ সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

২. নারী কর্মীদের জন্য স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর অভ্যন্তরীণ অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা (Internal Complaint Redressal Mechanism) অবিলম্বে চালু করা হোক।

৩. এনসিপি এই ঘটনায় দায় এড়িয়ে নয়, বরং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে সাহসী রাজনৈতিক অবস্থান নিক, যা দলকে আরও বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং নীতিনিষ্ঠ করে তুলবে।

আমি এই অভিযোগ করেছি দীর্ঘ আত্মসংযমের পর, অনেক চিন্তা ও মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। আমি দলীয়ভাবে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি এবং বিশ্বাস করি, সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে এনসিপি একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে, যেখানে নারী কর্মী কেবল ভুক্তভোগী নয়, বরং সম্মানিত ও নিরাপদ রাজনৈতিক অংশীদার।

নিবেদক,

নীলা ইসরাফিল সদস্য জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ধানমন্ডি থানার প্রতিনিধি (৫১)

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দশম শ্রেণিতে কত নম্বর পেয়েছিলেন সামান্থা

খিলক্ষেত দুর্গা মন্দির উচ্ছেদের ঘটনায় পূজা উদযাপন পরিষদের উদ্বেগ

বাংলাদেশকে দুঃসংবাদ দিল গ্লোবাল পিস ইনডেক্স

দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে যুবক খুন

জাতিসংঘের পরমাণু সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিত ইরানের

সাবেক তিন সিইসির বিচার হওয়া উচিত : রিজভী

‘নতুন সংকট’ নিয়ে ইরানকে জাতিসংঘের পরমাণু সংস্থার সতর্কবার্তা

জাল টেনেও সন্ধান মেলেনি পুকুরে ঘুরে বেড়ানো কুমিরের

আবার বাড়ছে স্বর্ণের দাম

আইনের তোয়াক্কা না করে এইচএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ছাত্রদল নেতা

১০

কারাগারে বসেই এইচএসসি পরীক্ষা দিল মামুন

১১

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির সাক্ষাৎ 

১২

ফাতিমার দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা

১৩

শিবির সভাপতির ছাত্রত্ব নিয়ে ছাত্রদল সভাপতির প্রশ্ন

১৪

আহ্বায়ক কমিটির নিষ্ক্রিয়দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে : ছাত্রদল সভাপতি

১৫

আরেক দেশের ২ মুসলিম নেতাকে হত্যা করল ইসরায়েল

১৬

শক্তিশালী সংসদ গড়তে সহায়তা করবে ইইউ : আমীর খসরু

১৭

ইরান কখনো আত্মসমর্পণ করবে না : খামেনি

১৮

ঘুষ দিলে গুদামে ওঠে ধান, ভিডিও ভাইরাল

১৯

ইউনূস-স্টারমার বৈঠক বাতিলের দায় কে নেবে, প্রশ্ন পররাষ্ট্র উপদেষ্টার

২০
X