তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের রশি টানাটানিতে থমকে গেছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ। এই প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরে চলছে পাল্টাপাল্টি মামলা। এ কারণে প্রায় পাঁচ মাস ধরে বন্ধ হয়ে আছে
মালিবাগ-কমলাপুর অংশের নির্মাণকাজ। আগামী ২৭ আগস্ট সিঙ্গাপুরের আদালতে শুনানি শেষে সমাধান আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের আশা। সে পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া সেতু কর্তৃপক্ষ আর কিছুই করতে পারছে না। অন্যদিকে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের জন্য ব্যারিকেড দেওয়ায় চার লেনের সড়ক পরিণত হয়েছে এক লেনে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। কখনো কখনো ১০ মিনিটের পথ পেরোতে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
রাজধানীর যানজট নিরসনে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের একটি এই এক্সপ্রেসওয়ে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে রেললাইন ধরে তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে এ উড়াল সড়ক। পুরো উড়াল সড়কের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। প্রায় ৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।
জানা গেছে, প্রথম ধাপে বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত অংশের অগ্রগতি হয়েছে ৯৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপ বনানী থেকে মগবাজার পর্যন্ত অংশের অগ্রগতি ৭৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। শেষ ধাপ মগবাজার-কুতুবখালী অংশের অগ্রগতি ১২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৭৪ দশমিক ২৩ শতাংশ।
মগবাজার থেকে মালিবাগ রেলগেট পর্যন্ত পুরো কাজটি হয়েছে রেললাইনের ওপর দিয়ে। কিন্তু রেললাইনের দুপাশে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় মালিবাগ থেকে কমলাপুর পর্যন্ত অংশ সড়কের ওপর করতে হচ্ছে। এক্সপ্রেসওয়ের পিলার নির্মাণের জন্য সড়কের মাঝের দুই লেন টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ফলে ব্যস্ততম এই পথের দুই পাশে সরু এক লেন দিয়ে কোনোরকমে যানবাহন চলছে।
গত জুনে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, ২০২৫ সালের শুরুর দিকে পুরো কাজ শেষ হবে। তবে ঠিকাদারদের চলমান বিরোধের জেরে প্রকল্প বাস্তবায়ন আরও বিলম্বিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এএইচএম সাখাওয়াত আক্তার কালবেলাকে বলছেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের আদালতে মামলা হয়েছে। আদালত এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজে স্থিতাবস্তা জারি করেছে। ফলে অপেক্ষা করা ছাড়া বিকল্প নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য তাগিদ দিচ্ছি। শেয়ার ট্রান্সফারের ইস্যু সমাধান হলে ব্যাংক থেকে টাকা ছাড়ের প্রতিবন্ধকতা দূর হবে। সেইসঙ্গে কাজ শুরু হবে। তখন আমরা জনবল বাড়িয়ে দ্রুত কাজ এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিতে পারব।’
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় পাঁচ মাস ধরে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। মালিবাগ রেলগেট থেকে কাঁচাবাজারের শেষ মাথা পর্যন্ত সড়কে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি হলেই সেখানে পানি জমে যায়। সেইসঙ্গে রাস্তার ওপর ফেলা হয়েছে বাজারের আবর্জনা। নির্মাণকাজের শুরু থেকে শুরুর মালিবাগ বাজার হয়ে আবুজর গিফারী কলেজের পাশ দিয়ে যাওয়া পথটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে এই এলাকার মানুষকে প্রতিদিনই চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা বলছেন, মালিবাগ থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পথ যেন আর শেষ হয় না। বাসাবো উড়াল সড়ক থেকে মালিবাগ রেলগেট পর্যন্ত যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টার বেশি। এর প্রভাব পড়ে আশপাশের সড়কগুলোতে। আবার মালিবাগ থেকে খিলগাঁও পর্যন্ত রাস্তায় যানবাহনকে এক লেনে চলতে হচ্ছে। সেখানে বাস, ট্রাক বা বড় কোনো যান বিকল হলে সৃষ্টি হয় দুর্ভোগের।
লাব্বায়েক, লাভলী, রাইদা, অনাবিল, সালসাবিল, তুরাগসহ বিভিন্ন পরিবহনের যাত্রী ও চালকরা বলছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ বন্ধ থাকলে আপাতত টিনের বেড়া খুলে দেওয়া উচিত। এতে ভোগান্তি কমবে।
মামলা চলছে ঢাকা ও সিঙ্গাপুরে:
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি)। এতে বেসরকারি অংশীদার ‘ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড’। এই কোম্পানির ৫১ শতাংশ মালিক থাইল্যান্ডভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই। বাকি ৪৯ শতাংশ চীনের দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএসআই ও সিনোহাইড্রো করপোরেশনের। চুক্তি অনুযায়ী, প্রকল্পে মোট ব্যয়ের ৭৩ শতাংশের জোগান দেওয়ার কথা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের। আর ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজের এক পর্যায়ে কোম্পানির মালিকানা নিয়ে ইতাল-থাইয়ের সঙ্গে দুই চীনা প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ঋণ দিচ্ছে এক্সিম ব্যাংক অব চায়না ও আইসিবিসি। চীনের এ দুই ব্যাংকের সঙ্গে ইতাল-থাইয়ের চুক্তিতে বলা হয়েছিল, সুদের কোনো কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলেই ঋণ চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। চুক্তিতে ইতাল-থাইয়ের শেয়ার চীনের দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তরেরও সুযোগ রাখা হয়। এর মধ্যে এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি একটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ঋণছাড় বন্ধ করে দিয়েছে দুই ব্যাংক। ঋণ পেতে হলে ইতাল-থাইয়ের সিংহভাগ শেয়ার সিএসআই ও সিনোহাইড্রোর কাছে হস্তান্তরের নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংক দুটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকের শর্ত মানলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে
ইতাল-থাইয়ের তেমন কোনো শেয়ারই থাকবে না। এজন্য ব্যাংকের নির্দেশনা স্থগিত চেয়ে বাংলাদেশের আদালতে আবেদন করে ইতাল-থাই। গত ১২ মে তাদের আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছে ইতাল-থাই। গত ৩০ মে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ইতাল-থাইয়ের শেয়ার চীনা কোম্পানির কাছে হস্তান্তরে আপাতত স্থিতাবস্থা বহাল রেখেছেন। সিঙ্গাপুরের আদালতে এ বিষয়ে চলমান আরেকটি মামলার শুনানি না হওয়া পর্যন্ত এ স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে বলে আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। আগামী ২৭ আগস্ট সিঙ্গাপুরে ওই মামলার শুনানির দিন ধার্য হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, ‘ঠিকাদারদের মামলাকে কেন্দ্র করে আইনি জটিলতায় কাজের গতি কিছুটা কমে গেছে। তবে উভয়পক্ষকে আমরা অনুরোধ করেছি, তারা যেন কোনোভাবেই কাজ বন্ধ না করে। কারণ কাজটি আমরা তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাই।’