শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
জাফর আহমেদ
প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৫ জুন ২০২৫, ০৮:৩৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এক মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিলে খরচা ১৮ ফ্ল্যাট

মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতি
এক মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিলে খরচা ১৮ ফ্ল্যাট

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যেমন বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছেন, আবার প্রকৃত অনেক মুক্তিযোদ্ধাও সরকারঘনিষ্ঠদের রোষে পড়ে ‘ভুয়া’ হয়ে গেছেন। তবে সব ছাপিয়ে তুঘলকি কাণ্ডটি ঘটে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নঈম জাহাঙ্গীরের বেলায়। নঈম জাহাঙ্গীর মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতির সদস্য। তাকে ‘শূলে চড়াতে’, অর্থাৎ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানাতে সমিতিকে মাশুল দিতে হয় ১৮টি দামি ফ্ল্যাট। সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর দুই মেয়ে, সাবেক দুই আইজিপিসহ প্রভাবশালীদের দেওয়া হয় এসব ফ্ল্যাট। এর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়েন সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. মোর্শেদুল ইসলাম।

সমিতির বঞ্চিত সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে সমিতির নামে বরাদ্দ পাওয়া জমিতে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। এর পর থেকেই সমিতির ২৭৫ জন সদস্যের মধ্যে আওয়ামীপন্থি ও বিএনপিপন্থি গ্রুপিং সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকায় নানাভাবে বিএনপিপন্থি সদস্যদের হয়রানি করা শুরু হয়। সমিতি থেকে বাদ দেওয়া হয় অনেক সদস্যকে। মূলত সমিতির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মো. মোর্শেদুল ইসলামের অনুসারীরা সমিতির দখল নিতে এসব ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু হয়রানির শিকার সমিতির সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা মো. নঈম জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে প্রতিবাদ করলে নঈমকেও সমিতি ছাড়া করা হয়। এরপর শুরু হয় মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের ষড়যন্ত্র। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বলে সমিতির কিছু সদস্য নঈম জাহাঙ্গীরের নামে লিখিত অভিযোগ দেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা)।

শুধু জামুকায় নয়, কুমিল্লা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে নঈমের নামে লিখিত অভিযোগও দেওয়া হয়। এ নিয়ে বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় নঈম জাহাঙ্গীরের মুক্তিযোদ্ধা গেজেট বাতিল করে।

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, নঈম জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মো. রফিকুল ইসলাম নামে সমিতির এক সদস্যের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি করে মন্ত্রণালয়। তদন্ত কমিটি ও বিশেষ সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১২ সালে নঈম জাহাঙ্গীরের মুক্তিযোদ্ধা গেজেট বাতিল করা হয়। এ নিয়ে প্রথমে নঈম জাহাঙ্গীর মন্ত্রণালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। পরে একই বছর আদালতে একটি রিট করেন। তারপরও বিভিন্ন উপায়ে তাকে ভুয়া প্রমাণ করতে চেষ্টা চালিয়ে যান সমিতির কয়েকজন সদস্য। কিন্তু লাল মুক্তিবার্তা এবং সরকার কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা সনদের জোরে দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে যান নঈম। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার ভাতাও গ্রহণ করেন। এসব নিয়ে নঈম জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পেরে না ওঠায় তাকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ করতে মন্ত্রী, সচিব, আইজিপিসহ আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের সঙ্গে সখ্য করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদসহ আওয়ামীপন্থি সদস্যরা। পরে প্রভাবশালী এসব ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতিতে অবৈধভাবে সদস্য করে নেওয়া হয়। প্রভাবশালী এসব ব্যক্তি এবং তাদের ছেলেমেয়ে ও ভাইবোনের নামে দেওয়া হয় ফ্ল্যাট বরাদ্দ। এরপর প্রভাব খাটিয়ে ২০২২ সালে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক নঈম জাহাঙ্গীরে ভাতা বাতিল করে দেন। গেজেট বাতিলের পর ভাতা বন্ধ করে দেওয়ায় আবারও নঈম জাহাঙ্গীর আদালতে রিট করেন। জামুকায়ও আবেদন করেন। গত মার্চে গেজেট বাতিলের বিষয়ে জামুকায় শুনানি হয়। শুনানিতে হাজির হয়ে তিনি কাগজপত্র পেশ করেন এবং তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এখন জামুকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা নঈম জাহাঙ্গীর।

মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির সদস্য সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা বেলায়েত হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘নঈম জাহাঙ্গীর একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বিএনপির সমর্থক হওয়ায় আওয়ামীপন্থি লোকজন মন্ত্রীর সঙ্গে সখ্য করে তার মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল করে। আর যাদের ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে, তারা সবাই সমিতির অবৈধ সদস্য। প্রভাব খাটিয়ে সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদুল ইসলাম এসব কাজ করেছেন।’

মো. নঈম জাহাঙ্গীর কালবেলাকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সমিতির কিছু সদস্য সাধারণ সম্পাদক মো. মোর্শেদের নেতৃত্বে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ষড়যন্ত্র করে গেজেট বাতিল করেছে। গেজেট বাতিলের প্রায় ১০ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে ভাতা পেতাম, তাও বন্ধ করে দেন মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল। মূলত সমিতির সদস্যদের অধিকার নিয়ে কথা বলায় আমার বিরুদ্ধে এমন অন্যায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে ২৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধার নামে প্রায় ১৬ একর জমি বরাদ্দ দেয় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। ২০১০ সালে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণকাজ শুরু হলে সমিতির সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধে। ভবন দৃশ্যমান হতে থাকলে দ্বন্দ্বের পারদ আরও বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে বিএনপিপন্থি তকমা দিয়ে সমিতির কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। পরে সমিতির সদস্য পদ বাতিলের বৈধতা দিতে ১৮ জনকে অবৈধভাবে সদস্য করে ফ্ল্যাট দেওয়া হয়।

অবৈধভাবে যাদের ১৮টি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়, তারা হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের পিয়ন মো. জাহাঙ্গীর আলম (ভবন নম্বর বি-২, টাওয়ার নম্বর-৩, ফ্লোর ১২, ফ্ল্যাট নং ৪), মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের মেয়ে মেহেরীন মুনজারিন (ভবন নম্বর বি-৪, টাওয়ার নম্বর-৩, ফ্লোর নম্বর ১২-এর ১নং ফ্ল্যাট), আরেক মেয়ে মেহেরীন মুসফেকিন (ভবন নম্বর-৪, টাওয়ার-৩, ফ্লোর ১২, ফ্ল্যাট নম্বর-৪), শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা নুরজাহান আহম্মেদ (ভবন নম্বর বি-৩, টাওয়ার-১, ফ্লোর-৭, ফ্ল্যাট নম্বর-৪), স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী মেসবাউল হক সাচ্চু (ভবন নম্বর বি-২, টাওয়ার-৩, ফ্লোর ১২, ফ্ল্যাট নম্বর-৩), গোপালগঞ্জের সাবেক মেয়র কাজী লিয়াকত আলী (ভবন নম্বর এ-৫, টাওয়ার-২, ফ্লোর-৪, ফ্ল্যাট নম্বর-৪), আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমের ভাই এইচ এম নিজামুদ্দিন (ভবন নম্বর এ-৫, টাওয়ার-২, ফ্লোর-৭, ফ্ল্যাট নম্বর-২), আরেক ভাই সফিউল আলম মুরাদ (ভবন নম্বর বি-২, টাওয়ার-১, ফ্লোর-১০, ফ্ল্যাট নম্বর-১), জাতীয় গৃহায়নের সাবেক সদস্য মো. আজহারুল হক (ভবন নম্বর এ-৪, টাওয়ার-১, ফ্লোর-৮, ফ্ল্যাট নম্বর-১), সাবেক আইজিপি বেনজীর আহম্মেদ (ভবন নম্বর এ-৪, টাওয়ার-১, ফ্লোর-৯, ফ্ল্যাট নম্বর ৪), মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিবের ছেলে আশিকুর রহমান (ভবন নম্বর এ-৪, টাওয়ার-২, ফ্লোর-৭, ফ্ল্যাট নম্বর ১০), সাবেক আইজিপি একেএম শহিদুল হক (ভবন নম্বর-৭, টাওয়ার-২, ফ্লোর-৮, ফ্ল্যাট নম্বর-৩), সাবেক সচিব সেলিনা সুলতানা (ভবন নম্বর বি-৩, টাওয়ার-২, ফ্লোর-৬, ফ্ল্যাট নম্বর ১), সাবেক সচিব খন্দকার মিজানুর রহমান (ভবন নম্বর বি-৩, টাওয়ার-২, ফ্লোর-১২, ফ্ল্যাট নম্বর ৩), সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি খুররম ফাতেমী (ভবন নম্বর বি-২, টাওয়ার-১, ফ্লোর-৮, ফ্ল্যাট নম্বর-১)।

অবৈধ সদস্যদের নামে বরাদ্দকৃত ফ্ল্যাট বাতিল করতে আদালতে রিট করার পাশাপাশি জাতীয় গৃহায়নে আবেদন করেন সমিতির বঞ্চিত সদস্যরা। এই বিষয়ে জাতীয় গৃহায়নের চেয়ারম্যান নূরুল বাসির কালবেলাকে বলেন, ‘যাদের নামে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়নি, অথচ তাদের নামে মুক্তিযোদ্ধা সমিতির ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাতিল চেয়ে আদালতে রিট করা হয়েছে। এটা আদালত দেখবেন। আর গৃহায়নের যে বিষয় আছে, সেই কাজ গৃহায়ন করছে। আমাদের কাজ চলমান।’

এদিকে, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর নানা দুর্নীতি, অনিয়ম, প্রভাব খাটানোসহ নানা অভিযোগে এবং ছাত্র-জনতা হত্যায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. মোর্শেদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বর্তমানে তিনি কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এই কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না : নাহিদ 

শাহ্‌ সিমেন্টের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর হলেন হামজা

১৩২ হলে শাকিব খানের ‘তাণ্ডব’

লোহার ফাঁকের ঈদ আনন্দ, কেরানীগঞ্জ কারাগারে মানবিক ছোঁয়া

সালাহউদ্দিন আহমদকে নিয়ে অপপ্রচার, প্রতিবাদে রামুতে বিক্ষোভ

নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করলেন তারেক রহমান

প্রতিক্রিয়া / সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চায় এবি পার্টি 

এশিয়া থেকে বিশ্বকাপে জায়গা নিশ্চিত তিন দেশের

ঈদের নামাজের রাকাত ছুটে গেলে কী করবেন

কোরবানি জন্য যত টাকা দিয়ে খাসি কিনলেন উপদেষ্টা আসিফ

১০

ভারত ইংল্যান্ডে হোয়াইটওয়াশ হলে টেস্টে ফিরবেন কোহলি!

১১

প্লাস্টিক দূষণ ঠেকাতে আর্থিক খাতের দায় 

১২

নির্বাচনের সময় নিয়ে জামায়াতে আমির যা বললেন 

১৩

জুলাইয়ে শহীদ সাইমনের পরিবারকে বিএনপি নেতা মিল্টন ভূঁইয়ার ঈদ উপহার

১৪

নেত্রকোনায় কালবেলার সাংবাদিকের বাবা-ভাইকে কুপিয়ে জখম

১৫

এপ্রিলে নির্বাচনে রাজি, তবে সংস্কার শেষে : সারজিস

১৬

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতার মৃত্যু, তোপের মুখে বিএনপির নেতারা

১৭

করিডোর হলো চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প : প্রধান উপদেষ্টা

১৮

নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করবেন খালেদা জিয়া

১৯

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি : সালাহউদ্দিন আহমদ

২০
X