‘বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত’ স্লোগান বুকে ধারণ করে প্রশিক্ষণের শেষ ধাপে ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম। সফলভাবে প্রশিক্ষণের সব ধাপ শেষ করার পর যুদ্ধবিমান নিয়ে সলো ফ্লাই (একক উড্ডয়ন) করার সময় যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে জনবিরল এলাকায় যুদ্ধবিমানটি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি। তার বিমানটি পতিত হয় রাজধানীর দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা একটি ভবনে। শেষ মুহূর্তে ইজেক্ট করে যুদ্ধবিমান থেকে তৌকির বেরিয়ে আসতে পারলেও গুরুতর আহত হন তিনি। তাকে উদ্ধার করে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এদিকে মাইলস্টোনে যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বৈমানিকসহ ২০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৭১ জন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে গতকাল দুপুর ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়ন করে। উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয় সেটি। দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতালা একটি ভবনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে।
আইএসপিআর জানিয়েছে, দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনের জন্য এরই মধ্যে বিমানবাহিনীর একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিমানবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামের সলো ফ্লাই বা কো-পাইলট ছাড়া একক উড্ডয়ন। প্রশিক্ষণে সলো ফ্লাইটটি হলো একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সার্কিট কমপ্লিট করা। রানওয়ে থেকে উড্ডয়ন করে চক্কর দিয়ে ল্যান্ড করা। উড্ডয়নের পর ল্যান্ডিং সবচেয়ে কঠিন বলে ধরা হয়। রানওয়ে থেকে উড্ডয়ন করার পর কোনো কারণে ল্যান্ড করতে সমস্যা হলে আবারও সার্কিটটি পূর্ণ করে নেমে আসতে হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তৌকির তিন দিন আগেই সলো ফ্লাইয়ের জন্য কোয়ালিফাই হন। তিন দিন আগে সলো ফ্লাই করার কথা থাকলেও খারাপ আবহাওয়া ও সাপ্তাহিক ছুটির কারণে সম্ভব হয়নি। গতকাল প্রথমে তৌকির প্রশিক্ষকসহ আকাশে ফ্লাই করেন। তার বিমান চালনায় সন্তুষ্ট হয়ে যুদ্ধবিমানটি ল্যান্ড করার পর প্রশিক্ষক ডুয়েল সিট থেকে নেমে যান। এরপর তৌকিরকে সলো ফ্লাই করার অনুমতি দেন প্রশিক্ষক।
জানা গেছে, তৌকিরের রানওয়ে থেকে শুরু করে টেক অফ সবই ভালো ছিল। সার্কিট শেষ করার পর অপেক্ষায় ছিলেন তার সতীর্থরা। একই সঙ্গে ওয়াকিটকি নিয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখছিলেন প্রশিক্ষক। কিন্তু টেক অফ করার ৫ থেকে ৭ মিনিট পর ফাইটার বিমানটির অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায়। বিমানটি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উত্তর দিকে দিয়ে ঘুরে দক্ষিণ দিকে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। ধারণা করা হচ্ছিল, যুদ্ধবিমানটি বিমানবন্দরের ইন্টারন্যাশনাল হেঙ্গার এলাকায় পড়ার কথা। কিন্তু আরও দূরে সরে যায় বিমানটি, বিধ্বস্ত হয় মাইলস্টোন স্কুলের ভবনে।
বিমানবাহিনী প্রধান বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন।
নিহত বৈমানিকের পরিবারকে আনা হলো ঢাকায়: বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত বৈমানিক তৌকির ইসলামের মৃত্যুর পর রাজশাহীর উপশহরের ৩ নম্বর সেক্টরের বাসায় চলছে শোকের মাতম। গতকাল বিকেলে তার বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের আহাজারি করতে দেখা যায়। পরে বিকেল ৫টার দিকে তৌকিরের বাবা তোহরুল ইসলাম, মা সালেহা খাতুন ও ছোট বোন বৃষ্টিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়।
তৌকিরের মেজো চাচা মতিউর রহমান বলেন, আমরা বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তার (পাইলট) মৃত্যুর খবর পাই। এরপর বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি হেলিকপ্টার পাঠানো হয়। তিনি জানান, তৌকির ছয় মাস আগে বিয়ে করেছিলেন। তবে তার কোনো সন্তান নেই। সম্প্রতি তিনি রাজশাহী এসেছিলেন। তার মরদেহ ঢাকা থেকে এলাকায় নেওয়ার পর কোথায় দাফন হবে সে সিদ্ধান্ত হবে।
মন্তব্য করুন