ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীন যাওয়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের দখল নেওয়া, পরে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ, অতঃপর গণতন্ত্রের জন্য দশকের পর দশক ধরে লড়ে যাওয়া—মোটাদাগে এটিই হচ্ছে মিয়ানমারের ইতিহাস। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেনাশাসনের অধীনে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি। শুরুতে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে হাঁটলেও নানা কারণে হোঁচট খেয়েছে একসময়ের বার্মা। ক্ষণে ক্ষণে আন্দোলন হয়েছে, হয়েছে রক্তাক্ত। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছে বিভিন্ন রাজ্যে। সর্বশেষ ২০২১ সালে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করায় ফের উত্তাল হয় মিয়ানমার। সেই আন্দোলনের আগুনে এখনো জ্বলছে দেশটি। এর মধ্যে কয়েকবার জান্তা সরকার নির্বাচনের উদ্যোগ নিলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। এখন তারা বলছে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হবে। তবে এ নির্বাচন নিয়েও সন্দেহ বিশ্লেষকদের। দেশটির গণতন্ত্রহীনতা, দীর্ঘ সেনাশাসন ও এর কারণ—এসব নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন হুমায়ূন কবির
বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারে গণতন্ত্র অধরা থাকার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রধান কারণগুলো হল— সামরিক বাহিনীর দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা, জাতিগত সংঘাত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দুর্বল প্রতিক্রিয়া।
প্রভাবশালী সেনাবাহিনী
মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী (তাতমাদো নামে পরিচিত) বরাবরই রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। ১৯৬২ সাল থেকে শুরু হওয়া সামরিক শাসন দেশটির গণতন্ত্রের পথে প্রধান বাধা। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা ছাড়তে অনিচ্ছুক এবং বিভিন্ন সময়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছে।
বিবিসির ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে আছে। এমনকি ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে কঠোর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাও সামরিক জেনারেলদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
প্রশ্ন উঠেছে যে, মিয়ানমারে এতো দীর্ঘ সময় ধরে কীভাবে সামরিক বাহিনী তাদের আধিপত্য বজায় রেখে আসছে এবং ভবিষ্যতেও তারা এ অবস্থা বজায় রাখতে যাচ্ছে কি না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন প্রশ্নের উত্তর আসলে দেশটির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। কারণ ‘মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটির চেয়ে বেশি পুরোনো’।
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ডেভিড আই স্টেইনবার্গ ‘দ্য মিলিটারি ইন বার্মা/মিয়ানমার’ নামে তার বইয়ে লিখেছেন, সামরিক বাহিনী তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কখনও ধরে রেখেছে বিভিন্ন ডিক্রি জারি করে, রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করে এবং সংবিধানে বিধি অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে।
তিনি বলেন, সামরিক বাহিনী বিভিন্ন সময় সংবিধানে নিজের অনুকূলে নানা বিধি অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং এগুলো তাদের অনুমোদন ছাড়া সংশোধনের উপায় নেই।
জাতিগত সংঘাত
মিয়ানমারের জাতিগত সংঘাতের নিয়ে ভাবতে গেলে প্রথমে তাদের জাতির বিন্যাসটা একটু বোঝা জরুরি। দেশটির জাতিগত জনসংখ্যার পরিস্থিতি বুঝতে হবে। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৬৮ ভাগ বামার হলেও সেখানে অন্যান্য জনগোষ্ঠী আছে আরও ৩২ ভাগ (৯% শান, ৭% কারেন, ৪% রাখাইন, ৩% বর্মী চীনা, ২% বর্মী ভারতীয়, ২% মোন এবং ৭% অন্যান্য) । ছোট-বড় ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে মিয়ানমার গঠিত। এর বাইরেও বেশ কিছু জাতিগোষ্ঠী আছে, মিয়ানমার সরকার যাদের নিজেদের জনগোষ্ঠী বলে স্বীকার করে না। যেমন রোহিঙ্গা, অ্যাংলো বার্মিজ, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, বার্মিজ ইন্ডিয়ানদেরকে তারা অস্বীকার করতে চায়। স্বীকৃত-অস্বীকৃত প্রায় দেড়শ জাতিগোষ্ঠী ৮টি প্রধান ভাগে বিভক্ত। এই ভাগাভাগি জাতিগত নয়, হয়েছে প্রদেশভিত্তিক। তবে শাসক দল, সরকার-প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে বামার বা বর্মীদের অবস্থান-প্রাধান্য অধিক।
মিয়ানমারে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে সংঘাত চলে আসছে। এই সংঘাতগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে, যা গণতন্ত্রের বিকাশে বাধা দেয়। সামরিক বাহিনী এই সংঘাতগুলোর সুযোগ নিয়ে নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করেছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
মিয়ানমারের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীলতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচিত সরকারগুলো প্রায়ই সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। ফলে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব দেখা দিয়েছে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়নি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দুর্বল প্রতিক্রিয়া
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া দুর্বল থেকেছে। ভূরাজনৈতিক কারণে আন্তর্জাতিক মহল সব সময় যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এর ফলে সামরিক জান্তা আরও উৎসাহিত হয়েছে এবং গণতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে।
এনএলডির দুর্বলতা
অং সান সু চির নেতৃত্বে এনএলডি মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে, তবে তারাও কখনো সামরিক বাহিনীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারেনি। দলটিকে বার বার দমন করা হয়েছে এবং তাদের কার্যক্রম সীমিত করা হয়েছে।
সংবিধান ও নির্বাচন
মিয়ানমারের সংবিধান সামরিক বাহিনীর স্বার্থ রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশন প্রায়ই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা গণতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। এমনকি দেশটির সংবিধান অনুযায়ী সংসদে তাদের সংরক্ষিত আসনও রয়েছে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর ওপর কর্তৃত্বও সেনাবাহিনীর।
এই কারণগুলো সম্মিলিতভাবে মিয়ানমারে গণতন্ত্রকে অধরা করে রেখেছে।
মন্তব্য করুন