অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার ১৬ দিন পর গত ২৫ আগস্ট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর তার এ ভাষণ ছিল বহুল প্রত্যাশিত। রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং রাজনীতি সচেতনমহল মাত্রই আশা করছিল যে, প্রধান উপদেষ্টা আরও আগে জাতির উদ্দেশে তার প্রথম ভাষণ উপস্থাপন করবেন। তবে যে প্রেক্ষাপটে প্রফেসর ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তার আগে এবং পরে যেসব ঘটনা ঘটে গেছে, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে ভাষণ প্রদানে বিলম্ব হয়েছে, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতন এবং সরকারপ্রধানের পলায়নের পর ৮ আগস্ট রাতে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার আগপর্যন্ত দেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। আর এর সুযোগ নিয়ে দেশে আইনবিরোধী সব ঘটনা ঘটে গেছে। যার রেশ এখনো অব্যাহত আছে।
এমনকি প্রধান উপদেষ্টা যখন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন, সেদিন হাজার হাজার আনসার সদস্য সচিবালয়ে ঘেরাও করে রাখেন। সচিবালয়ের ভেতরে আটকা পড়েন বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা এবং অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী। এক অস্থির সময় অতিক্রম করছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ভয়াবহ বন্যায় প্রায় অর্ধকোটি মানুষের জীবন ও সম্পদ বিপন্ন। বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনও একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসবে। আইনশৃঙ্খলা, অর্থনীতি, ব্যাংকিং সেক্টর, শিক্ষাঙ্গনসহ অসংখ্য বিষয় পর্বতসমান সমস্যা হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বিরাজ করছে, যা নিয়ে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করে যেতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল স্বাগত জানালেও নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপি একটি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। প্রফেসর ইউনূস বলেন, আমরা সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনকেও সংস্কার করব। কমিশনকে যে কোনো সময় আদর্শ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখব। তার ভাষণের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, একটা সংলাপ শুরু করার জন্য দেশবাসীর প্রতি তার অনুরোধ। অন্তর্বর্তী সরকার কী কী কাজ সম্পূর্ণ করে যাবে, কী কী কাজ মোটামুটি করে গেলে হবে—এ আলোচনার মাধ্যমে তার সরকার একটা দিকনির্দেশনা পেতে পারে বলে প্রফেসর ইউনূস উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক আলোচনা থেকেই আসবে। জাতীয় নির্বাচন কখন হবে, সেটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে, আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন।’
আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রত্যাশী (সম্ভবত তাই ঘটবে) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে ‘জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন’ ছিল বলে সন্তোষ প্রকাশ করলেও নির্বাচন নিয়ে রোডম্যাপ না থাকায় হতাশার কথা জানিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের এক দিন পর অর্থাৎ ২৬ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম প্রধান উপদেষ্টা একটা রোডম্যাপ দেবেন। আমরা সেই রোডম্যাপ পাইনি, ধোঁয়াশা এখনো পরিষ্কার হয়নি।’ ‘কবে নির্বাচন হবে এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’—প্রধান উপদেষ্টার এ কথা উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘উনি সঠিক বলেছেন, অবশ্যই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হবে। এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তো রাজনৈতিক নেতা, রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।’ প্রধান উপদেষ্টা খুব দ্রুত সেই প্রক্রিয়ার দিকে যাবেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবেন বলে বিএনপি মহাসচিব আশা প্রকাশ করেন। তিনি এর আগে কয়েকবার যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলেছেন। বিএনপি মহাসচিব মাঝেমধ্যে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের কথাও বলছেন।
সংগত কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘কবে নির্বাচন হবে এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’, প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য এবং বর্তমান প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি মহাসচিবের ‘যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা’—এ বক্তব্যের মধ্যে দূরত্ব কতখানি? খুব বেশি দূরত্ব যে আছে তা হয়তো নয়। কারণ, প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীকে একটি সংলাপ শুরু করার তাগিদ দিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনসহ জাতীয় ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দ্রুত সংলাপ চাচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো আগে নিজেদের মধ্যে সংলাপ শুরু করতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপের আগে প্রস্তুতি হিসেবে তারা এটা করতে পারে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছর ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশের (যা স্বৈরাচারী সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী সন্ত্রাসী কায়দায় পণ্ড করে দেয়) আগে বিএনপি রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কারের ৩১ দফা রূপরেখা তুলে ধরে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যা প্রকাশ করেন। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিএনপির ৩১ দফা রূপরেখা খুব একটা প্রচার পায়নি। যদিও ওই রূপরেখা আগামী দিনের বাংলাদেশের জন্য রাজনীতি, অর্থনীতি, সুশাসনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারসহ দলের ইতিবাচক অঙ্গীকারের প্রতিফলন ঘটেছিল।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন বাস্তবতায় বিএনপি তার ৩১ দফা সংস্কারের প্রস্তাবনার পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজনের প্রয়োজন আছে কি না, তা ভেবে দেখতে পারে। সমমনা দল এবং যাদের সঙ্গে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে গণতন্ত্র এবং ভোটের আবিষ্কার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, তাদের সঙ্গে বিএনপি ৩১ দফা রূপরেখা এবং নির্বাচনের যৌক্তিক সময় নিয়ে আলোচনা শুরু করতে পারে। বিএনপি প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে ‘গণতন্ত্র উত্তরণের রোডম্যাপ না পাওয়া এবং ধোঁয়াশা পরিষ্কার না হওয়ার’ যে কথা বলেছে, তা পরিষ্কার হওয়া দরকার। যৌক্তিক সময় বলতে বিএনপি কি ছয় মাস, এক বছর নাকি কমবেশি সময় বলতে চাচ্ছে, তা জানাতে পারে। সংগত কারণেই হয়তো বিএনপি তা এখনই খোলাসা করতে চাচ্ছে না। তবে বিএনপি সমমনা দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনের যৌক্তিক সময় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে বৈঠক শুরু করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে ঐকমত্য হতে পারে। এতে করে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপের সময় তাদের দিক থেকে আলোচনা চালানো সহজ হবে। হয়তো অহেতুক জটিলতা তৈরি হবে না। এমনিতেই নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অনেক।
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুধু কঠিন নয়, এক জটিল সময় পার করছেন। প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা বলা হয়তো অবান্তর হবে না যে, শেষ পর্যন্ত তাকে একটি অবাধ, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। তিন-তিনটি একতরফা, রাতের ভোট ও ডামি নির্বাচনের পর এ ধরনের একটি নির্বাচন আয়োজন করা সত্যিকার অর্থে শুধু চ্যালেঞ্জ নয়, রীতিমতো দুরূহ ব্যাপার। আবার এ কথাও ঠিক যে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য হতে পারে না। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের ওপরই বর্তায়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের সম্ভাব্য যৌক্তিক সময় নির্ধারণ করতে, বিএনপি এবং রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের আগে নিজেদের মধ্যে সংলাপের সূচনা করতে পারে, যা প্রধান উপদেষ্টা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ অনেকখানি সহজ করতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক