একদিন জালাল উদ্দিন রুমি বসে আছেন তার আস্তানায়। কথা এগিয়ে চলছে। শিষ্যরা প্রশ্ন করছেন আর রুমি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একে একে জবাব দিচ্ছেন। একজন শিষ্য হঠাৎ মনের খেয়ালে ও উৎসুকে পাঁচটি বিষয়ের সংজ্ঞা জানতে চাইলেন। শিষ্য গুরুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—বিষ, ভয়, হিংসা, ক্রোধ ও ঘৃণা কাকে বলে। শিষ্যের প্রশ্নের উত্তর চমৎকারভাবে দিয়েছিলেন রুমি। তিনি পাঁচটি বিষয়ের পাঁচটি চমৎকার সংজ্ঞা দিলেন। প্রাসঙ্গিকভাবে বিষের সংজ্ঞা দিলেন এভাবে—প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত যা কিছু সবই বিষ। ক্ষমতা, সম্পদ, লোভ, প্রশংসা, অহংকার, ভালোবাসা, খিদে, নিন্দা সবকিছুর জন্য এটি প্রযোজ্য। এ সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়—সারা পৃথিবীর পরিবেশ, প্রতিবেশ আর মানবিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সব সেক্টরে প্রয়োজনের বাইরে মানুষের যে বাড়াবাড়ি রকমের ভোগবাদিতা; তাই আজ বিষ হিসেবে বিষাক্ত করে চলেছে সব বিষয়কেই।
পৃথিবীর অন্য নাম ধরিত্রী ও বসুন্ধরা। ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় ‘ইবু পার্থিবি’ মানে ‘ধরিত্রী মাতা’। (ইবু মানে মা, পার্থিবি মানে পৃথিবী)। আমরা সবাই এই ধরিত্রী মাতার অংশ। প্রকৃতির সবকিছুই একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। গাছের শিকড় যেমন মাটির নিচে তার সংসার বুনে, মানুষও তেমন প্রকৃতির সঙ্গে সংসার বুনেছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায়ও কিন্তু এমনটা দাবি করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান একে অন্যের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। প্রকৃতিকে বিষাক্ত করার মাধ্যমে আমরা এই আদান-প্রদান সিস্টেমকে বিনষ্ট করে ফেলি। সংগতকারণেই আমাদের পৃথিবী মাকে বিষমুক্ত রাখার দায়িত্ব সব সন্তানের।
পানির অতি ব্যবহারে আমরা পৃথিবীর ভূ-প্রকৃতিতে বিষাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করছি। আধুনিক মানুষ তার জীবন জৌলুসের বিভিন্ন উপকরণ বানাতে গিয়ে ভোগবাদিতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছে, যা প্রকারান্তরে বিষময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে চলেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—এক কেজি ধান উৎপাদনে ৩৩০০ লিটার পানি লাগে। এক পাইন্ট (৪৭৩ মিলিলিটার) বিয়ার তৈরি করতে মোটামুটি ২০ লিটার পানি লাগে। এক গ্যালন আইসক্রিম বানাতে দুধ লাগে ১২ পাউন্ড এবং সুতির একটি টি-শার্ট তৈরি করতে প্রায় ৭০০ গ্যালন পানি লাগে। বিশ্বে প্রতি বছর ৮০ লাখ টনের বেশি প্লাস্টিক মহাসাগরে পড়ে। এটি প্রতি মিনিটে এক ট্রাক বর্জ্য ফেলার সমতুল্য। এর অর্ধেক বর্জ্যই এশিয়ার পাঁচটি দেশ—চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে সাগরে পড়ে। বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, সাগর-মহাসাগরগুলোয় বর্তমানে ৩ কোটি টনের মতো প্লাস্টিক বর্জ্য রয়েছে। অর্থাৎ ৫১ লাখ কোটি প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা ভেসে বেড়াচ্ছে। সূর্য যে ছায়াপথের সদস্য, সেই আকাশগঙ্গার মোট নক্ষত্রের চেয়ে এই সংখ্যা ৫০০ গুণ বেশি। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, যে হারে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে, তাতে ২০৫০ সাল নাগাদ সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের সংখ্যাই বেশি হবে।
মানুষ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে—‘পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর প্রাণী হচ্ছে মানুষ’। মানুষের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে মানবতা প্রদর্শন করে প্রকৃত মানুষ হওয়া আর সহজ কাজটি হচ্ছে অমানুষ হওয়া। মানুষ তার এ অমানুষ হওয়ার সহজ প্রবণতা বজায় রেখে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে, যা পরিণামে তার নিজেরই ক্ষতি ডেকে আনে। মানুষের এই অপরিণামদর্শী কাজে পৃথিবীর প্রাণ প্রতিবেশ বিষিয়ে যায়। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এরকম আত্মবিধ্বংসী উদাহরণ কম নেই। তার দুইটি উদাহরণ দিচ্ছি—
চীনে চড়ুই নিধন ও দুর্ভিক্ষ: প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সবচেয়ে বড় ধরনের বিপাকে পড়া জাতি হিসেবে সবার আগে নাম আসে চীনাদের। ১৯৪৯ সালে চীনের ক্ষমতায় আসে কমিউনিস্ট পার্টি। দলটির নেতা মাও সে তুং চীনের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ নামে এক আন্দোলন শুরু করেন। এর আওতায় কৃষি ও ফসল রক্ষার জন্য চড়ুইপাখি মারার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এ পরিকল্পনার নাম ছিল ‘ওগেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’। এরকম সিদ্ধান্তের পক্ষে মাও সে তুং বলেছিলেন, ‘চড়ুই ক্ষেতের শস্য খেয়ে মানুষের ক্ষতি করছে।’ এর ফলে রাতারাতি দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মেরে ফেলা হয় ৬৫ কোটি চড়ুই। এর ফল হলো উল্টো। যে ফসল রক্ষার নামে প্রায় বিলুপ্ত করা হলো চড়ুইপাখি, সেই পাখি নিধনের ফলে বেড়ে গেল ফসল ধ্বংসকারী কীটপতঙ্গের সংখ্যা। এবার এই কীটেরা বিনা বাধায় আরও কয়েকগুণ বেগে শস্য উজাড় করতে থাকল। ফলে ১৯৬০-৬২ সালে চীনে নেমে এলো ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়-দুর্ভিক্ষ। ‘দ্য গ্রেট ফেমিন’ নামে এ দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা তিন থেকে সাড়ে চার কোটি। ফলে কয়েক বছর ধরে খেসারত দিতে হয় চীনাদের।
মানব বিষে শকুন মারায় মানুষের মৃত্যু: আমেরিকান ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে বিপুলসংখ্যক শকুনের মৃত্যুর ফলে মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য সংক্রমণ ছড়িয়ে পাঁচ বছরে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গরুসহ পচাগলা প্রাণীদেহ খেয়ে ঐতিহ্যগতভাবে শকুন প্রকৃতিকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সহায়তা করত। গবেষণাটির সহলেখক ইয়াল ফ্রাঙ্ক যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যারিস স্কুল অব পাবলিক পলিসি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করে শকুন। আমাদের পরিবেশ থেকে ব্যাকটেরিয়াসহ বিভিন্ন জীবাণু বহনকারী মৃত প্রাণী অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পাখিটি। এই শকুনের উপস্থিতি ছাড়া রোগজীবাণু ছড়াতে পারে। তারা শুধু দেখতেই সুন্দর না, পরিবেশের জন্য দরকারিও। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রাণিজগতের সবার আলাদা দায়িত্ব আছে।
১৯৭০ সালে বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ওয়াল্ট কেলি পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ একটি বিখ্যাত দূষণবিরোধী কার্টুন আঁকেন কার্টুন চরিত্র পোগোর ভাষ্যে। এ কার্টুনে আমরা মানবজাতির ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক একটি উক্তি পাই। আর তা হলো: আমরা শত্রুর সাক্ষাৎ পেয়েছি আর সে হচ্ছে আমরা।
আসুন আমরা শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে ‘বিষ বিশ্বময়’ প্রত্যয়টি মিথ্যা প্রমাণ করি আমাদের নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক এবং উপসচিব, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ