ঢাকায় এখন আওয়ামী লীগের তিনটি অফিস। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। ধানমন্ডির ৩/এ সড়কে আওয়ামী লীগের দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়। আর তেজগাঁওয়ে স্থাপন করা হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কার্যালয়। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমা নেওয়া হয়েছে ধানমন্ডির কার্যালয়ে। তবে এবার মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমা নেওয়া হচ্ছে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলীয় কার্যালয় থেকে। এ কারণে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এখন প্রতিদিন লোকারণ্য। হাজার হাজার মনোনয়নপ্রত্যাশী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করছেন, জমা দিচ্ছেন। সবাই যাচ্ছেন বিশাল মিছিল নিয়ে। ফলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে এখন পা ফেলার জায়গা নেই। এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একদিন তিনবার চেষ্টা করেও দলীয় কার্যালয়ে ঢুকতে পারেননি। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া এখন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। প্রতিটি আসনে শেষ পর্যন্ত একজন মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু মনোনয়ন ফরম কিনছেন আরও অনেক বেশি মানুষ। প্রতিটি ফরমের দাম ৫০ হাজার টাকা। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের জন্য ৫০ হাজার টাকা যেন হাতের ময়লা। মনোনয়ন পাবেন না জেনেও অনেকে মনোনয়ন ফরম কিনছেন, জমা দিচ্ছেন। তারা আসলে দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে নিজের অবস্থান জানান দিয়ে রাখতে চাইছেন। জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন না পেলেও ভবিষ্যতে অন্য কোনো প্রাপ্তির সম্ভাবনা জিইয়ে রাখতেই মনোনয়ন ফরম কেনার এই লড়াই। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের কয়েক কোটি টাকা আয় হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টি, জাসদসহ নির্বাচনে আগ্রহী অন্য দলগুলোও মনোনয়ন ফরম বিক্রি করছে। নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টির অবস্থান স্পষ্ট না হলেও তারা তাদের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে সারা বাংলাদেশে যখন সাজ সাজ রব, তখন বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এখন পরিণত হয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিতে। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে তাদের নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় কার্যত তালাবদ্ধ। গুলশানের বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়েও সুনসান নীরবতা। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ, দণ্ডিত হলেও সরকারের অনুকম্পায় তিনি এখন বাসায়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান দণ্ড মাথায় নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে আছেন। সেখান থেকেই ভার্চুয়ালি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অধিকাংশ সক্রিয় নেতা এখন কারাগারে। কার্যত বিএনপি এখন চালাচ্ছেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। আগের আন্দোলনের সময় তিনি নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করেই দল চালাতেন। তিনি ছিলেন দলের আবাসিক নেতা। এবার সে সুযোগও নেই। এখন তিনি গোপন জায়গা থেকে ভিডিওতে দল চালান। তার কাজ এখন একটাই। একটা কর্মসূচি শেষে আরেকটা কর্মসূচি ঘোষণা করা। বিএনপির কর্মসূচির রুটিনও এখন সবার মুখস্থ হয়ে গেছে। রোববার-সোমবার হরতাল বা অবরোধ। মঙ্গলবার বিরতি। আবার বুধবার-বৃহস্পতিবার হরতাল বা অবরোধ। শুক্রবার-শনিবার বিরতি। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে এ রুটিনেই এখন চলছে বিএনপি। দেশের মানুষও বাধ্য হয়ে এর সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। এখন সপ্তাহের সবচেয়ে ব্যস্ত দিন শুক্র ও শনিবার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস-পরীক্ষা, ব্যবসায়িক, সামাজিক কাজকর্মের জন্য সবাই এখন নিজেদের মতো করে রুটিন সাজিয়ে নিয়েছে।
বিএনপি এখন সরকার পতনের একদফার আন্দোলন করছে। কিন্তু টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা একটি দলকে এই রুটিন আন্দোলন দিয়ে যে হটানো যাবে না, আমার ধারণা, এটা বিএনপি এটা সবার চেয়ে ভালো জানে। কিন্তু তার পরও তারা কীসের আশায় জনগণকে জিম্মি করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, তা তারাই ভালো বলতে পারবে।
চলমান আন্দোলনের একটা লাভক্ষতির হিসাব করি চলুন। বিএনপির কোনো লাভ নেই, পুরোটাই ক্ষতি। আন্দোলনের কারণে তাদের নেতাকর্মীরা দৌড়ের ওপর আছেন। মাঠে নামতে পারছেন না। আবার গ্রেপ্তারের ভয়ে ঘরেও থাকতে পারছেন না। যদি এমন হতো, টানা এক মাস এই রুটিনে আন্দোলন করলে সরকারের পতন ঘটবে, তাও না হয় মানা যেত। কিন্তু তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। বিএনপির ক্ষতি আসলে বহুমুখী। ২০১৪-১৫ সালের আন্দোলনের পর বিএনপির নামের সঙ্গে সন্ত্রাসী সংগঠন বিশেষণটি জুড়ে গিয়েছিল। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তারা সন্ত্রাসের অবস্থান থেকে সরে আসে। দীর্ঘদিন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে নিজেদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করে বিএনপি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে আবার বিএনপি প্রমাণ করছে, তারা আসলে অগ্নিসন্ত্রাসীদেরই দল। তাদের এই আন্দোলনে আরেকটা বিষয় প্রমাণিত হচ্ছে, তাদের সঙ্গে জনগণ নেই। কারণ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় গোপন জায়গা থেকে। কয়েকজন দুর্বৃত্ত যানবাহনে আগুন দেয়। এই হলো তাদের কর্মসূচি। এখানে জনগণের কোনো ভূমিকা নেই।
বিএনপির পুরোটাই ক্ষতি। কিন্তু সরকারের সে অর্থে ক্ষতি নেই। অর্থনীতির ঝুঁকি আরও বাড়ছে বটে। কিন্তু এ মুহূর্তে তাতে সরকারের থোড়াই কেয়ার। তারা এখন ব্যস্ত আগামী নির্বাচন নিয়ে। আওয়ামী লীগ বরং বিএনপিকে সন্ত্রাসীদের দল, অগ্নিসন্ত্রাসীদের দল হিসেবে প্রমাণ করতে পারছে।
এই আন্দোলনে ক্ষতি যদি কারও হয়, তবে সেটা জনগণের। আন্দোলনের প্রভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। অর্থনীতির ঝুঁকি বাড়ছে। সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের রুটিন লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। তাহলে এই নামকাওয়াস্তে আন্দোলন দিয়ে বিএনপি দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়?
সবাই জানেন, বিএনপি আসলে অন্য কোনো আশায় বসে আছে। মাঠে রুটিন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আর অপেক্ষা করছে, বিদেশি শক্তিরা এসে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। সেটা সবাই চায়। কিন্তু মার্কিন চাপে যদি বাংলাদেশে সত্যি সত্যি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়, কিন্তু বিএনপি তাতে অংশ না নেয়; তাহলে কী হবে? বিএনপি তখন কী করবে? তারা কি এভাবেই মাসের পর মাস অকারণ আন্দোলন চালিয়ে যাবে? এর আগেও বিএনপি টানা অবরোধ দিয়েছিল। কিন্তু একসময় বিএনপির প্রত্যাহারের ঘোষণা ছাড়াই তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। চলমান আন্দোলনের পরিণতিও যদি সেটার মতো হয়, তাহলে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী?
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ভালো হয়নি। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন, আবারও বাংলাদেশে ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হবে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তার চেয়ে বড় কথা হলো, আগের দুটি নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনকার মতো সরব ছিল না। এবার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে, তাহলে সেটাই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে। বিএনপি ক্ষমতায় আসবে কি আসবে না, সেটা তো নির্বাচনের আগে বলা সম্ভব নয়। তবে একটি ভালো নির্বাচনে বিএনপির পক্ষে অনেক ভালো ফলাফল করা সম্ভব। তাই মাঠে অপ্রয়োজনীয় আন্দোলনের চেয়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়াই উত্তম।
দিনের পর দিন সরকারের দমন-পীড়ন, মামলা-হামলা মোকাবিলা করে টিকে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীদের জন্যও কঠিন। এভাবে চলতে থাকলে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ