নানা চড়াই-উতরাইয়ে বিজয়ের তেপ্পান্নতে বাংলাদেশ। পাকিস্তানিদের প্রচারণা ছিল বাঙালরা ভাতের কাঙাল, হাভাতে, আলসে আরও কত কী? যুদ্ধ শুরু হলে বলতে থাকে এরা ভীরু, যুদ্ধবিদ্যায় বকলম। এই অলস, যুদ্ধে বকলম, ভীরু-ভেতোরা মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে দেখিয়ে দিয়েছে যুদ্ধবিদ্যায় পারঙ্গম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে। কেবল ছ্যাঁচা মার নয়, মাথা নুইয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে। গোটা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখেছে নিরস্ত্র-নিরীহ একটি জাতির হিম্মত-হেডম। প্রত্যক্ষ করেছে পাকিস্তানের হরিহর সমর্থক চীন-মার্কিনসহ তাদের বন্ধু দেশগুলোর মুখ লুকানোর নমুনা। আবার সেই গোহারার শোধ তারা নেওয়ার চেষ্টা করেছে স্বাধীনতার পর চুয়াত্তরে, পঁচাত্তরেও।
সেই ট্র্যাজেডিতে অনেক কিছু হারিয়ে এই বায়ান্ন-তেপ্পান্ন বছরে বাংলাদেশ এগিয়েছেও অনেক। আবার বিশ্বব্যাপী শত্রু-মিত্রের সংজ্ঞা-উদাহরণও পাল্টেছে। নতুন বিশ্বায়নের তোড়ে গতকালের শত্রু আজকের বন্ধু। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আজকের বন্ধুই আগামীকালের শত্রু। আর স্থানিক পর্যায়ে নানান সূচকে অগ্রগতির মাঝেও ছন্দপতন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মধ্যেই খাদ্যস্ফীতি। দুর্ভিক্ষের সুরও। কম আয়ের, নির্ধারিত আয় ও কম বেতনের চাকরিজীবীদের কষ্টের দিনে কিছু মানুষের সম্পদ উপচে পড়ছে। নির্বাচনের প্রার্থী বিশেষ করে মন্ত্রী-এমপি ও তাদের স্ত্রী-স্বজনদের প্রদর্শিত আয়ের হলফনামায় দুইশ গুণ পর্যন্ত আয় বৃদ্ধির তথ্য ঘুরছে গণমাধ্যমে। এর বাইরে তাদের অপ্রদর্শিত আয় কত বেড়েছে আল্লাহ মালুম। এর মধ্যেই সরকার দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনছে। এর জন্য আগে থেকেই দোষ চাপানো হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনের পরও বিভিন্ন রকমের চাপ আসতে পারে। বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির দেশি-বিদেশি অশুভ পরিকল্পনাও রয়েছে। আর সেই সময়টা নির্বাচনের দুই মাস পর আগামী বছরের মার্চের দিকে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের যখন হাঁসফাঁস অবস্থা, তখন স্বয়ং সরকারপ্রধানের এমন বক্তব্য উদ্বেগ ও শঙ্কার না জাগিয়ে পারে না। নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে বিদেশিদের ষড়যন্ত্রে তাল মিলিয়ে রাজনীতিতে বিপর্যস্ত বিএনপি দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটাতে পারে—এমন দাবিকে শুধু রাজনৈতিক ভাবা যায় না।
নির্বাচন নিয়ে সরকার যতটুকু বিদেশি চাপের মুখোমুখি হয়েছে, তা প্রধানত এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। কিন্তু সরকারের দিক থেকে বলা হয়েছে, তারা কোনো চাপ বোধ করছে না। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ১১ ডিসেম্বর বলেছেন, নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব অনেকটাই কমেছে। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর বিএনপিকে দেখতে পারে না, পছন্দ করে না। এর আগে, দলের সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তলে তলে বোঝাপড়া হয়ে গেছে। তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই নেই। দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি-শঙ্কা কোনোটাই থাকার কথা নয়। মানে নো চিন্তা, ডু ফুর্তি। কিন্তু ফুর্তিটা একতরফা এবং সীমিতদের মধ্যে, যারা বেহেশতের বাংলাদেশ ব্রাঞ্চে আছেন। বাদবাকিরা যাবে কই? অবশ্য ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা সপ্তাহখানেক ধরে বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কার কথা বলে চলেছেন। তারা একই সঙ্গে এটাও দাবি করছেন যে, নিষেধাজ্ঞা এলে তা হবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অর্থাৎ তার জন্য ব্যবসায়ীদের কোনো দায় নেই। কোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কখনো কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল দুর্ভিক্ষের কারণ হয়, এমন নজির নেই। তবে রাজনৈতিক বিরোধ দুর্ভিক্ষের কারণ হতে পারে, যদি তা সংঘাতের রূপ নেয়। নইলে গৃহযুদ্ধ ঘটলে খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন হলে দুর্ভিক্ষ আসে।
দুর্ভিক্ষ কেন হয়, দীর্ঘ গবেষণার ভিত্তিতে তার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন ১৯৯৮ সালে নোবেল পাওয়া বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। বাংলার দুটি দুর্ভিক্ষ ‘১৯৪৩ সালের মন্বন্তর ও ১৯৭৪ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ’ ছিল তার গবেষণার অভিসন্দর্ভ। তাতে তিনি দেখিয়েছেন, চাহিদার তুলনায় মোট কতটা খাদ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেটা দুর্ভিক্ষের কারণ নয়। উৎপাদন আগের তুলনায় বাড়লেও অর্থাৎ খাদ্য ঘাটতি না থাকলেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে। বাংলার দুই দুর্ভিক্ষই হয়েছে মূলত খাদ্য বিতরণব্যবস্থায় সংকটের কারণে। অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, উভয় দুর্ভিক্ষেই খাদ্য সংকটের ঝাপটা শহরাঞ্চলের মানুষের ওপর দিয়ে যায়নি, বরং গ্রামাঞ্চলেই তার রূপ ছিল ভয়াবহ। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে কলকাতায় না খেয়ে মানুষ মরেনি, মরেছে গ্রামাঞ্চলে। ১৯৭৪ সালেও বাংলাদেশে শহরাঞ্চলের মানুষের জন্য রেশনে চাল-গম দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল, যা গ্রামে ছিল না। এ কারণে প্রায় যে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের অধিকাংশই গরিব এবং জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা মানুষ।
এখন তো দুর্ভিক্ষের শঙ্কার সেই অবস্থা নেই। আবার আছেও। সেটা যত না স্থানিক, তার চেয়ে বেশি কূটনৈতিক। নতুন স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে পুরোনো সেই পাল্টাপাল্টির কিছুটা নমুনা আবারও। বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময়, ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন বৈরী গণপ্রজাতন্ত্রী চীন নিয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষ। দেশ স্বাধীনের পর যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ব্যাপক সাহায্য দিতে থাকে এবং ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের পট-পরিবর্তনের পর এ সাহায্য আরও বাড়তে থাকে। সেই বাড়া-কমা এবং সম্পর্কের উন্নতি-অবনতির মধ্যে সন্নিকটে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তা সামনে রেখে যখন দেশের শাসক ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে চূড়ান্ত রেষারেষি তখন বাংলাদেশ ঘিরে কূটনৈতিক অঙ্গনে নজিরবিহীন লড়াই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার। রুশ-মার্কিন কূটনৈতিক লড়াই ঘিরে উত্তাপের পারদ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ নিয়ে দুই মহাশক্তিধর দেশের লড়াইয়ের মধ্যে নানা বার্তা নির্দেশ করে।
মস্কোতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা ঢাকায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ তোলেন। পাল্টা জবাব দিয়েছে ওয়াশিংটনও। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরবের একটি মন্তব্য ঘিরে তুঙ্গে ওঠে রুশ-মার্কিন বিবাদ। ঢাকায় তিনি খোলাখুলি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা চাপ প্রয়োগ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশে আমাদের বন্ধুরা তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে অবিচল, যা জাতীয় স্বার্থে পরিচালিত হয়।’
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে গত দেড়-দুই বছর বাংলাদেশের রাজনীতি উত্তপ্ত। একেবারে সে দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের মতোই হাস বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। বারবার অবাধ ভোটের কথা বলে বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন পুরোটাই প্রশ্নবিদ্ধ। হাসের এ আচরণে শাসক দল আওয়ামী লীগ যেমন বিরক্ত, তেমনই খুশি বিরোধী দল বিএনপি। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সম্প্রতি বলেন, বাংলাদেশে ভোট হওয়া উচিত দেশের বর্তমান সংবিধান মেনে। এর অর্থ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, হাসিনা সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক। দিল্লি, মস্কো ও বেইজিংয়ের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবেই বর্তমান সরকারকে চাপে ফেলতে তৎপর। তাদের সঙ্গে মিলেছে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। মোটকথা সত্তরের দশকে পাকিস্তানকে সামনে রেখে বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর দড়ি টানাটানির ক্রিয়াকর্ম এখন বাংলাদেশকে নিয়ে। বাংলাদেশ নতুন করে ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব হয়ে ওঠেনি। বরাবর গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিল। আবার ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে বাংলাদেশকে সরাসরি সহায়তা করেছে। এর আগে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। যার বড় ঘটনা চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ। যার বদনাম বহু বছর টানতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। তখন বিএনপি সৃষ্টি হয়নি। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের আগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানের মতো বৈরী অবস্থা তৈরি হয়। জন্ম নেয় জাসদের মতো দল। এরপর আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে ‘বাকশাল’ গড়তে হয়। হিসাব-নিকাশ বা নমুনায় কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও হাল বাতাসের কিছু গন্ধ। দুর্ভিক্ষের শঙ্কা জানান দেওয়াটা তাই রাজনীতির না অতিরাজনীতির, সেই প্রশ্নও পিছু ছাড়ছে না।
হালকা-মাঝারি-ভারী কত বিষয় নিয়েই কথা হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত-অবান্তর বিষয়াদি নিয়েও আলোচনা-সমালোচনাও জমে। অথচ খাদ্য নিয়ে আমরা কোন ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছি, তা এখন পর্যন্ত ভাবনায়ও আসছে না অনেকের। ওই ভবিষ্যৎটা অবশ্যই দুশ্চিন্তার-উদ্বেগের। যার সূচনা ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিক থেকে এবং শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই। করোনা মহামারির দুই বছর সারা বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন কমতে থাকে। সাপ্লাই চেইনেও ঘটতে থাকে বিপর্যয়। করোনা একটু দমতে না দমতেই ২০২২ থেকে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ দেয় আরেক ধাক্কা। মূল্যস্ফীতি, খাদ্য সরবরাহ হ্রাস, জ্বালানি ও গ্যাস সরবরাহ হ্রাস এবং মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি-রপ্তানি মন্দা, বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে পড়ে গোটা বিশ্ব। তা সামলাতে দেশে দেশে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বনসহ ব্যাংক ও মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন আনতে হয়। বাস্তবে সামলানো যায়নি। বড়জোর সাময়িক ঠেক দেওয়া গেছে আর খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ছুটতে ছুটতে এখন ক্রান্তিকালে।
লেখক: ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন