বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ২৯ কার্তিক ১৪৩২
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪৬ এএম
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মালদ্বীপের ভারত বৈরিতা

মালদ্বীপের ভারত বৈরিতা

ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিককালের সম্পর্কের সমীকরণ বদলে ফেলার মধ্যেই মালদ্বীপের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করেছে প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জুর দল পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস (পিএনসি)। সাময়িক ফল অনুযায়ী, ৯৩ সদস্যের প্রতিনিধি পরিষদে মি. মুইজ্জুর দল পিএনসি পেয়েছে ৬৬টা আসন।

বিশ্লেষকদের মতে, পিএনসির জয় চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর নীতির প্রতিই মালদ্বীপের জনগণের জোরালো সমর্থন বলে মনে করা হচ্ছে। চীনপন্থি হিসেবে পরিচিত মোহামেদ মুইজ্জু মালদ্বীপে দীর্ঘদিন ধরে থাকা ভারতের প্রভাব কমাতে চান এবং সেটা তিনি প্রকাশ্যেই বলছেন। বিবিসি বলছে, তার দলের এ জয়কে ‘সুপার মেজরিটি’ হিসেবে বর্ণনা করেছে স্থানীয় গণমাধ্যম। সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদে যে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা দরকার, এ নির্বাচনের মাধ্যমে তার দল পিএনসি সেটি অর্জন করেছে।

মোহামেদ মুইজ্জু ক্ষমতায় এসেছিলেন গত বছর শেষের দিকে। নির্বাচনে তার প্রধান প্রচারণা ছিল ‘ভারত প্রথম’ নীতির বিরুদ্ধে। এতে বিপুলভাবে সফল হন তিনি এবং প্রথা ভেঙে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়ার পর এখনো তিনি দিল্লি সফরে যাননি।

মালদ্বীপে থাকা ভারতীয় সেনাদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভারতীয় সেনাদের মালদ্বীপ থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা অনুযায়ী চলতি বছরের ১০ মের মধ্যে মালদ্বীপ ছাড়ার কথা ভারতীয় সেনাদের। মালদ্বীপে ভারতীয় সেনার ৮৮টি ট্রুপ রয়েছে।

বিনামূল্যে সামরিক সহায়তা পেতে চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের দিনই মুইজ্জু বলেন, ‘১০ মে থেকে দেশে (মালদ্বীপে) কোনো ভারতীয় সেনা থাকবে না। ইউনিফর্ম এবং বেসামরিক পোশাকেও নয়। আমি এটি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছি।’

কট্টর ভারতবিরোধী অবস্থানের জন্য দেশের ভেতরে তার বিরোধিতাও আছে। কিছুদিন আগে খবর বেরিয়েছে যে, ভারতের বিরুদ্ধে একগুঁয়েমি বন্ধ করতে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। একই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গত বছর সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান দিয়ে মোহাম্মদ সলিহকে (৬২) পরাজিত করেন মোহামেদ মুইজ্জু (৪৫)। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ওপর জোর দিয়েছেন মালদ্বীপের শীর্ষ একজন বিরোধী নেতাও। মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এমডিপি) নেতা ও মালদ্বীপের প্রবীণ কূটনীতিক আবদুল্লাহ শহিদ জোর দিয়ে বলেছেন, নতুন সরকার বৈদেশিক নীতির যতই পরিবর্তন করুক না কেন, ‘ভারতের সঙ্গে ঘোলাটে সম্পর্ক অসম্ভব’।

ভারত নিজেও পরিস্থিতি বুঝতে পারছে যে, প্রভাব বিস্তার করে সব সম্পর্ক ঠিক রাখা যায় না। আনন্দবাজার পত্রিকার এক রিপোর্টে দেখা যায়, ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মালদ্বীপের বর্তমান সরকারের ভারতবিরোধী অবস্থান প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সব দেশ, সবসময় ভারতের সঙ্গে একমত হবে, ভারতকে সমর্থন করবে, এই নিয়ে “গ্যারান্টি” দেওয়া সম্ভব নয়। রাজনীতি আসলে রাজনীতিই।’

মালদ্বীপের অতি চীন নির্ভরতার সমালোচনাও আছে। অনেক কারণের মধ্যে চীনের ঋণ যে শ্রীলঙ্কাকে বিপদে ফেলেছিল সেটাও বলছেন অনেক বিশ্লেষক। সম্প্রতি চীনের সঙ্গে ২০টি চুক্তি করেছে মালদ্বীপ। দ্বীপরাষ্ট্রকে অবকাঠামো উন্নয়নে সাহায্য দেওয়ার কথাও জানিয়েছে বেইজিং। এর জন্য চীন থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে মালদ্বীপ। মনে করা হচ্ছে, এর ফলে আরও বিপাকে পড়তে চলেছে দ্বীপদেশটি। চীনের কাছে ক্রমেই হাত-পা বাঁধা পড়তে চলেছে তাদের।

ভারত এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে মালদ্বীপের তিন মন্ত্রী কুমন্তব্যও করেছিলেন। এসব মন্তব্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘জোকার’ এবং ‘ইসরায়েলের ক্রীড়নক’ বলেও অপমান করা হয়েছে। কটাক্ষ করা হয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়েও। ভারতের চাপের মুখে ওই তিন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছিল মুইজ্জুর সরকার।

ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপের সরকারবিরোধী অভ্য়ুত্থান দমন করেছিল ভারতীয় সেনা। যার নাম ছিল অপারেশন ক্যাকটাস। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ভারতীয় সেনা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদ্ধারকাজ চালিয়েছে।

ভারত বরাবরই মালদ্বীপের পাশে থেকেছে কারণ, ভারতীয় মূল ভূখণ্ড থেকে মাত্র ৩০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে মালদ্বীপ। লাক্ষাদ্বীপ থেকে মাত্র ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে। ভারত মহাসাগরের ওপর অবস্থিত ছোট্ট এ দ্বীপ কৌশলগতভাবে ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ রাস্তাই হলো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ। অন্যদিকে, ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও এ অঞ্চলটি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাণিজ্য, পর্যটন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল।

প্রশ্ন হলো, কেন ভারতের প্রতি ‘কঠোর’ অবস্থান মুইজ্জু সরকারের? বলা হচ্ছে, মালদ্বীপকে ভারতের ছায়া থেকে বার করে আনতে চান মুইজ্জু। তার এরকম ভারত বৈরিতার কারণ কী কী হতে পারে, তা নিয়েও একাধিক মত রয়েছে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।

মুইজ্জুর ইন্ডিয়া আউট নীতিকে মালদ্বীপের কূটনৈতিক অবস্থানে বড়সড় পরিবর্তনের সূচক বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশেষজ্ঞদের একাংশ। ভারত-ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে নতুন বন্ধু খোঁজার চেষ্টা করছে এ দ্বীপরাষ্ট্রটি। মুইজ্জু দৃঢ় তার অবস্থানে। যে নীতির ওপর ভিত্তি করে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন, সেই নীতিকে একেবারেই হালকাভাবে নিতে রাজি নন তিনি। বরং সেই নীতিকে মালদ্বীপের রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকার পন্থা হিসেবেই মুইজ্জু দেখছেন বলে মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের। ভোটে জিতে তিনি যে ভারতকে চাপে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তা তার একের পর এক সিদ্ধান্ত থেকেই স্পষ্ট।

গণতন্ত্রের রাস্তা ধরে পথচলা শুরু করার পর মালদ্বীপের সব প্রেসিডেন্টেরই প্রথম গন্তব্য হয়েছে ভারত। এমনকি ভারতবিরোধী বলে পরিচিত প্রেসিডেন্টরাও শপথ নেওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরে ভারতেই এসেছেন। কিন্তু মুইজ্জু সেই নিয়ম ভেঙে দিয়েছেন। মুইজ্জু তার বিদেশ সফর শুরু করেছিলেন তুরস্কে গিয়ে। প্রথম বন্ধু হিসেবেই যে দেশকে মুইজ্জু বেছে নিয়েছেন, সেই তুরস্কের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব একটা মধুর নয়। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা (৩৭০ ধারা) তুলে দেওয়া নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই সরব হয়েছিল তুরস্ক।

ভারত মনে করে, মুইজ্জুর ইন্ডিয়া আউট নীতির নেপথ্যে কাজ করছে তার চীনপন্থি মনোভাব। পাশাপাশি চীনের নানা উসকানি ও প্রলোভন। মুইজ্জু সম্প্রতি বেজিং থেকে ঘুরেও এসেছেন। সেখান থেকে ফিরেই ভারতকে সেনা সরানোর কথা জানিয়েছেন। এটা পরিষ্কার যে, ভারতের প্রতি বৈরিতা দেখিয়ে চীনের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতামূলক বন্ধুত্ব তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে মালদ্বীপ সরকার।

চীনের আগ্রহ অর্থনৈতিক কারণেও। মালদ্বীপের দ্বীপগুলো ব্যস্ততম সামুদ্রিক বাণিজ্যপথের ওপর অবস্থিত। যে পথ দিয়ে চীনের ৮০ শতাংশ তেল আমদানি হয়। ভারতীয় কূটনীতিকরা বলছেন, ভারত-মালদ্বীপ বিতর্কে আগ বাড়িয়ে খেলতে চাইছে চীন। মালদ্বীপে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে তৎপর হয়ে উঠেছে বেইজিং।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অপমান করায় পাল্টা মালদ্বীপ বয়কটের ডাক এসেছে ভারতীয় নাগরিক সমাজ থেকে। মালদ্বীপের পর্যটকদের বড় অংশই ভারতীয়। ভারত থেকে প্রতি বছর দুই লাখেরও বেশি মানুষ মালদ্বীপ ঘুরতে যায়। ভারতের ক্ষুদ্রতম কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাক্ষাদ্বীপ নিয়ে এখন মেতেছে মোদি সরকার। মালদ্বীপের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়েনের আবহেই এবার আরব সাগরের সেই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নয়া বিমানবন্দর চালু করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে সামরিক এবং অসামরিক দুই ধরনের প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবনায় রেখেই তৈরি হয়েছে নয়া বিমানবন্দর।

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আধিপত্যের মোকাবিলা করতে সক্রিয় মোদি সরকার। আমেরিকার নেতৃত্বে গড়া কোয়াডে তারা প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। কিন্তু তার আগে সমুদ্রপথ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগে পড়ছে সাউথ ব্লক। তার অন্যতম কারণ মালদ্বীপের সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, চীন ঘনিষ্ঠ মোহামেদ মুইজ্জু।

ভারতে এখন লোকসভা নির্বাচন চলছে। বড় করেই বোঝা যাচ্ছে যে, টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। এ নির্বাচনের ফল, মোদির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং দিল্লির সাউথ ব্লকের ভাবনা আগামী দিনগুলোতে কেমন হয় সেটা দেখার অপেক্ষায়।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আগুন

অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীর পাশে ছাত্রদল নেতা দয়াল

একজন উপদেষ্টা ধানমন্ডিতে ভোটার হতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন : ব্যারিস্টার অসীম

‘গণভোটের চেয়ে আলুচাষিদের ন্যায্যমূল্য পাওয়া বেশি প্রয়োজন’

খতমে নবুওয়তের মহাসম্মেলন সফলে ঢাকায় গণমিছিল

চলন্ত পিকআপ থেকে ককটেল বিস্ফোরণ

ইস্তানবুল হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড মিরপুর শাখার উদ্বোধন

ধানের শীষে ভোট দিলে জনগণ নিরাপদে থাকবে : মাসুদুজ্জামান

বৃহস্পতিবার রাজধানীর ১৪ স্পটে অবস্থান নেবে শিবির

দুই ইউপি সদস্যসহ আ.লীগের ৫ নেতা গ্রে’প্তা’র

১০

কক্সবাজারে সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ২৮ পয়েন্টে নিরাপত্তা চৌকি

১১

রাজধানীতে থেমে থাকা ট্রেনের বগিতে আগুন

১২

ব্যানারসহ ছাত্রলীগের ৩ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার

১৩

যুবককে দুবাই নিয়ে বিক্রি, দুই মানব পাচারকারীর কারাদণ্ড

১৪

অস্তিত্ব সংকটে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সুতিকাগার সলঙ্গা হাট

১৫

রূপসা নদীতে নিখোঁজের ৩ দিন পর যুবকের মরদেহ উদ্ধার

১৬

ধানমন্ডিতে ৪ ককটেলসহ একজন আটক

১৭

বায়রার ফখরুলকে ‎ছেড়ে দেওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তাকে আদালতে তলব

১৮

ফোন বন্ধের আতঙ্কে বাজারে মন্দাভাব, আন্দোলনে চট্টগ্রামের মোবাইল ব্যবসায়ীরা

১৯

ডাকসুতে শেখ হাসিনার আজীবন সদস্যপদ বাতিলের সিদ্ধান্ত

২০
X