রাজধানী ঢাকায় টানা আন্দোলনের কারণে নগরবাসীর ভোগান্তি ব্যাপক হারে বাড়ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঢাকার রাজপথে আন্দোলন-বিক্ষোভ বেড়েই চলেছে। অনেকে ঢাকাকে আন্দোলনের শহর হিসেবেও অবহিত করেছেন। কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সময়ে-অসময়ে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথ দখল করায় ভুগছেন নগরবাসী।
বিভিন্ন দাবিতে গতকাল সোমবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্থানে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে শ্রমিক, জনতা এবং সরকারি কর্মকর্তারা। এতে রাজধানীতে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া অনেক সেবাপ্রত্যাশী সেবা থেকে বঞ্চিত হন। জনগণ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল—সব জায়গায় এই কঠিন পরিস্থিতির প্রভাব পড়ছে।
বকেয়া বেতন ও বোনাসের টাকা পরিশোধের আশ্বাস না পাওয়ায় কারখানা মালিককে অবরুদ্ধ করে গতকাল বিক্ষোভ করছেন রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া কয়েকশ শ্রমিক। তারা গাজীপুরের সিজন্স ড্রেসেস লিমিটেডে কর্মরত। বেলা সাড়ে ১১টায় সরেজমিন গিয়ে সেখানে দেখা গেছে, ভবনের সামনের ফটকে ও আশপাশের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছেন তারা। শুধু তাই নয়, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে না সরারও ঘোষণা দিয়েছেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস এবং শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শফিউল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, গতকাল বৈঠকে পাওনা পরিশোধে কার্যকর কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার পর থেকেই সেখানে অবস্থান রয়েছেন শ্রমিকরা। রাতেও ছিলেন। এখনো অবরুদ্ধ মালিকপক্ষের একাংশ। আজকের মধ্যে কোনো আশ্বাস না পেলে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
এদিকে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ বাতিলের দাবিতে গতকাল সোমবার দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করেছেন সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা। এ নিয়ে তাদের এ আন্দোলন এক মাসে গড়াল। অধ্যাদেশকে ‘কালো আইন’ আখ্যা দিয়ে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আন্দোলনকারী কর্মচারীরা। কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্দোলনকারীরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অবস্থিত সচিবালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে অবস্থান নিয়ে অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে বক্তব্য দেন। বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান বাদিউল কবীর জানান, আগামীকাল মঙ্গলবার গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করবেন তারা।
তিন দফা দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে পদযাত্রা করেছেন চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যরা। সোমবার সকালে রাজধানীর জাতীয় শহীদ মিনার থেকে এই পদযাত্রা কর্মসূচি শুরু করেন চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্য ও কারাবন্দি বিডিআর সদস্যদের সন্তানরা। পরে শাহবাগ থানার সামনে তাদের পদযাত্রা এলে পুলিশের ব্যারিকেডের কারণে তারা এগোতে পারেননি। ‘জাস্টিস ফর বিডিআর’ ব্যানারের অধীনে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে বহিষ্কৃত ও কারাবন্দি বিডিআর সদস্যদের পরিবারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা তিন দফা দাবি হলো—পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারের পুনর্বিবেচনা; নিরপরাধ কারাবন্দিদের মুক্তি; চাকরিচ্যুত সদস্যদের ক্ষতিপূরণ ও চাকরিতে পুনর্বহাল।
গতকাল সোমবার সকাল থেকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘এন্ট্রি লেভেলের’ শিক্ষক পদে প্রার্থী বাছাইয়ে অনুষ্ঠিত অষ্টাদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে ‘অনুত্তীর্ণ’ বা ‘ফেল করা’ প্রার্থীরা তাদের উত্তীর্ণ ঘোষণা করে ই-সনদ দেওয়ার দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন অষ্টাদশ শিক্ষক নিবন্ধনের চূড়ান্ত পরীক্ষায় ফেল করা প্রার্থীরা। রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তাদের অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে। বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে যেতে চাইলে প্রথমে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন তারা। পরে সেখান থেকে অন্তত ৪-৫ জনকে আটক করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে বলে অভিযোগ আন্দোলনরতদের। গত রোববার সড়ক অবরোধ করে অবস্থান করলে জলকামানের পানি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তারা প্রিলিমিনারি ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভায় ভালো করলেও তাদের ‘ফেল করানো হয়েছে’। তাই তারা শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার সনদ দাবি করছেন।
এ ছাড়া বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছেন তার সমর্থকরা। একই সঙ্গে ডিএসসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বড় একটি অংশ এ আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আছে। তারা মূল ফটক আটকানোর পাশাপাশি ডিএসসিসির সব বিভাগের অফিস গেটে তালা ঝুলিয়ে রেখেছে। ফলে বন্ধ রয়েছে সেবা কার্যক্রম, ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবাপ্রার্থীরা। নগর ভবনে চলমান আন্দোলনের কারণে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন, ওয়ারিশ ও চারিত্রিক সনদ, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন, হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধসহ বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সেবা বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া স্থবির হয়ে পড়েছে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। অল্প বৃষ্টিতে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। এর মাঝে বেড়েছে মশার উপদ্রব। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
যদিও গতকাল সোমবার (২৩ জুন) সকালে টানা ৪০ দিন বন্ধ থাকার পর নগর ভবনের তালা খুলে দেন ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা। একই সঙ্গে খুলে দেওয়া হয়েছে নাগরিক সেবাদানকারী সব দপ্তরের তালা। ফলে নাগরিকদের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা নেই। সরেজমিন দেখা গেছে, নগর ভবনের প্রধান ফটকের তালা এবং অন্যান্য দপ্তরের তালা খুলে দেওয়া হলেও এখনো তালাবদ্ধ ডিএসসিসির প্রশাসক শাহজাহান মিয়াসহ বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীর কক্ষ।
এদিকে নাগরিক সেবা চালু হলেও নগর ভবনে এখনো সাধারণ মানুষের তেমন আনাগোনা শুরু হয়নি। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এখনো নাগরিকরা সেবা চালুর কথা জানেন না বলে ভিড় কম। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, এতদিন দপ্তরে তালা থাকলেও মশক এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ চলমান ছিল।
মন্তব্য করুন
আর্কাইভ 
| ২৬ জুন ২০২৫ 