আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইমেজ ফেরানোর চেষ্টায় রয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে ইসি ও সরকারবিরোধী দলগুলোর আস্থা অর্জনে চেষ্টা করে যাচ্ছে হাবিবুল আউয়াল কমিশন। তারই অংশ হিসেবে আগামী নির্বাচনে ইসির পর্যবেক্ষক তালিকায় রাখা হয়নি বিতর্কিত পর্যবেক্ষক সংস্থা ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম ও সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনকে। এর আগে বিরোধী দলগুলোর মনোযোগ আকর্ষণে ইভিএম প্রকল্প বাতিল করে ব্যালটে ভোটের সিদ্ধান্ত, নানা অনিয়মের অভিযোগে গাইবান্ধার নির্বাচন বাতিল করে দোষীদের শাস্তির সুপারিশ, ডিসি-এসপিদের সঙ্গে বৈঠক করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কড়া বার্তা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করা হয়।
ইসি সূত্র জানায়, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নানাভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের চেষ্টা করে। সর্বশেষ ইসির পর্যবেক্ষক তালিকা থেকে পুরোনো তালিকায় থাকা অধ্যাপক আবেদ আলীর বিতর্কিত পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’ ও ‘সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন’কে বাদ দিয়ে তালিকা প্রকাশ করে ইসি। এর আগে অধ্যাপক আবেদ আলীর নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রচার হয়। এ দুটি সংগঠনকে অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে নানা চেষ্টা-তদবিরের পরও কমিশন তাদের পর্যবেক্ষক তালিকায় রাখেনি। কমিশনের এমন সিদ্ধান্তে ইসির ইমেজ বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও প্রকাশিত ৬৮টি পর্যবেক্ষক সংস্থার কোনো কোনোটি ভুঁইফোঁড় সংস্থা বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা শুনানির পর তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার চিন্তাও কমিশনের রয়েছে বলে জানায় সূত্রগুলো। এর আগে বর্তমান কমিশন গঠন ও শপথের পর থেকেই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়ে। ফলে শুরুতেই তাদের মন গলানোর উদ্যোগ নেয় কমিশন। এর অংশ হিসেবে ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করা হয়। বিরোধী দলগুলো সে সংলাপ বর্জন করলে শুরুতেই হোঁচট খায় কমিশন। এরপর সিইসিসহ অন্য কমিশনাররা নানা ইতিবাচক বক্তব্যের মাধ্যমে বিরোধীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। সম্প্রতি বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করে আবারও চিঠি দেয় কমিশন। দলগুলো তাদের সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
গত বছরের ১২ অক্টোবর নানা অনিয়মের অভিযোগে গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনের ভোট বন্ধ করে দিয়ে রেকর্ড তৈরি করে বর্তমান কমিশন। শুধু ভোট বাতিলই নয়, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ভোটে অনিয়মে জড়িত পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশও করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইসির এমন সিদ্ধান্তে নাখোশ হলেও কমিশনের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানায় দলমত নির্বিশেষে সবাই। সিসি ক্যামরায় বিভিন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্তও ছিল প্রশংসার।
গত অক্টোবরে জেলা পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিসি-এসপিদের ঢাকায় ডেকে মতবিনিময় করে বর্তমান কমিশন। সেখানে জাতীয় নির্বাচন নিয়েও মাঠ কর্মকর্তাদের কড়া বার্তা দেয় কমিশন। ইসির কড়া ভাষায় নির্দেশনা নিয়ে প্রশাসন খানিকটা ক্ষুব্ধ হলেও সেসময় ইসির প্রশংসা করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলোর বিরোধিতার মুখে এবং দেশের অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে ব্যয়বহুল ইভিএম প্রকল্প থেকে সরে আসে নির্বাচন কমিশন। অতীতের ধারাবাহিকতায় আগামী জাতীয় নির্বাচন ব্যালটেই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান কমিশন।
জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘ট্রায়াল’ হিসেবে নেওয়া পাঁচ সিটিতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে সম্প্রতি অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় বর্তমান কমিশন। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীসহ সব প্রার্থী এবং তাদের লোকজনকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য একাধিকবার নোটিশ করা ছাড়াও প্রার্থীদের জবাবদিহির আওতায় এনে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় ইসি। এসব নির্বাচনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চান তারা। পাঁচ সিটির ভোটের মাধ্যমে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইসিকে এরই মধ্যে আশ্বস্ত করেছে, তারা ভোট সুষ্ঠু করতে ইসির নির্দেশনা মেনে চলবে। ফলে এসব সিটির অভিজ্ঞতা নিয়ে ইসি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিকল্পনা ঢেলে সাজাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বা পরবর্তী বছরের শুরুতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করার প্রস্তুতি রয়েছে কমিশনের। নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলকে অংশগ্রহণ করাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে ইসি। তার আগে নিজেদের ইমেজ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। তারই অংশ হিসেবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জোরালো দাবি মেনেই ব্যালটে ভোট করছে ইসি। এ ছাড়া সম্প্রতি বিতর্কিত ও আলোচিত দুটি পর্যবেক্ষক সংস্থাকে জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষণের সুযোগ রাখা হয়নি। বিরোধীদের আস্থা অর্জনের জন্য ইসির এমন উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ কালবেলাকে বলেন, সুষ্ঠু ভোটের জন্য কমিশনের আন্তরিকতার কমতি নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে কমিশন সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে লক্ষ্যে নানা ধরনের কার্যক্রম চলছে ও তা অব্যাহত থাকবে।
মন্তব্য করুন