ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন সামিউল ইসলাম (৩৫)। দ্রুত তাকে নিয়ে আসা হয় মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রক্তক্ষরণের কারণে তার প্রয়োজন হয় দুই ব্যাগ রক্তের। কিন্তু ঈদের টানা ছুটিতে রাজধানী ঢাকা ফাঁকা থাকায় দুই ব্যাগ এ পজিটিভ রক্ত জোগাড় করতে স্বজনদের বেগ পেতে হয়। গ্রাম থেকে শ্যালক সাইমকে ঢাকায় এসে রক্ত দিতে হয়। আরেক ব্যাগ বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে জোগাড় হয়। এমন দুর্ভোগের চিত্র শুধু সামিউল ও তার স্বজনদের নয়, গোটা দেশের। রক্তের প্রয়োজনে রোগীর স্বজনদের দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে মেটাতে হয় রক্তের চাহিদা। অথচ রক্তের চাহিদা চিরন্তন। বিশ্বের প্রায় ৬২টি দেশে শতভাগ স্বেচ্ছা রক্তদানের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে জরুরি প্রয়োজনে রক্তের সিংহভাগ জোগান এখনো নিকটাত্মীয়নির্ভর। এমন পরিস্থিতিতে রক্তদান ও গ্রহণে জনসচেতনতা তৈরিতে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ শনিবার, ১৪ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস-২০২৫। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘রক্ত দিন, আশার আলো দিন : একসঙ্গে আমরা জীবন বাঁচাই’। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দিবসটি পালন করার কথা রয়েছে।
জানা যায়, বিশ্বজুড়ে এখন ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী সুস্থ মানুষকে বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করে সরকার। ফলে রক্তদাতা উৎসাহিত হয় স্বেচ্ছায় রক্তদানে। দক্ষিণ কোরিয়ায় রক্তদাতাদের সব ধরনের রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিনামূল্যে করা হয়। ফ্রি মেডিকেল চেকআপের ব্যবস্থাও রয়েছে। যুক্তরাজ্যে প্রদান করা হয় হেলথ কার্ড। রক্তদাতারা কম খরচে চিকিৎসাসেবা পেয়ে থাকেন। অস্ট্রেলিয়ায় স্বাস্থ্য বীমায় রক্তদাতাদের স্কিম কম নেওয়া হয়। জাপানে সম্মানিত করা হয় রক্তদাতাকে। যেদিন তিনি রক্তদান করবেন, সেদিন তার জন্য ছুটি এবং সেদিনের বেতন পাবেন। যুক্তরাষ্ট্রেও বিশেষ বীমা এবং সিঙ্গাপুরে স্বাস্থ্যসেবায় রক্তদাতাদের বিশেষ ছাড় বা সুযোগ প্রদান করা হয়। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতে আইন করে রক্তদাতাদের ছুটি প্রদানের সুযোগ রাখা হয়েছে। ব্রাজিল ও চীনেও স্বাস্থ্যসেবায় বড় সুযোগ প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে রক্তদাতাদের জন্য বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। এজন্য মুমূর্ষু রোগীর রক্তের জন্য স্বজনদের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে চাহিদার অনুপাতে রক্তদাতাও বাড়ছে না। বছরে কত ব্যাগ রক্তের চাহিদা রয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে সেই তথ্যও নেই দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে। ১৫ বছর আগের ১০ লাখ ইউনিট বা ব্যাগ রক্তের চাহিদায় আটকে আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অথচ গত ১৫ বছরে দেশে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাসেবার পরিধি ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। মানুষের রক্তের চাহিদাও বেড়েছে। কিন্তু সরকারি হিসেবে রক্তের চাহিদা বাড়েনি। সেই তথ্যে মোট চাহিদার ৩২ শতাংশ স্বেচ্ছায় রক্তদাতার মাধ্যমে পূরণের কথা উল্লেখ রয়েছে। এরপর থেকে সবসময় বলা হয়, স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা ৩২ শতাংশেই আটকে আছে। কারণ কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও সেই তথ্য জানে না। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা তাদের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি হবে।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনো রক্তের প্রধান উৎস আত্মীয় বা অর্থের বিনিময়ে সংগৃহীত রক্ত, যা নিরাপদ নয় এবং নৈতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ। এ চিত্র বদলাতে হলে স্বেচ্ছায়, নিয়মিত রক্তদানের চর্চা বাড়ানো জরুরি। রক্তদাতাদের সম্মানিত করা, একটি জাতীয় রেজিস্ট্রি তৈরি, দাতা পরিচয়পত্র চালু, স্বাস্থ্যসেবায় কিছু ছাড় ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা হলে তরুণরা উৎসাহিত হবে। নেপালে আজীবন বিনামূল্যে রক্ত সরবরাহ, শ্রীলঙ্কায় সরকারি স্বীকৃতি, ভারতে চিকিৎসা সেবায় ছাড়—এ উদাহরণগুলো আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘রক্তদানের গুরুত্ব পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা, বিলবোর্ডে প্রচারণা এবং গণমাধ্যমে নিরাপদ রক্তের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। রক্তদাতাদের জন্য যাতায়াতে সহযোগিতায় পাঠাও, উবার, ওভাইয়ের মতো প্ল্যাটফর্মকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া রক্ত সংগ্রহের খরচ যেন রোগীর স্বজনকে না বহন করতে হয়, সেজন্য হাসপাতাল থেকেই সম্মানজনক ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালকে একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্মে আনা গেলে প্রতারণা, বিভ্রান্তি ও দেরি তিনটি সমস্যা থেকেই মুক্তি মিলবে। নিরাপদ রক্তদানে রাষ্ট্রকে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে রক্তের চাহিদার একটা বড় অংশের প্রয়োজন হয় থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য। হেমাটোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। এ ছাড়া থ্যালাসেমিয়ার বাহক রয়েছে এক কোটি ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে। একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর প্রতি মাসে ১ থেকে ৩ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। থ্যালাসেমিয়া ছাড়াও রক্তস্বল্পতা, প্রসূতির রক্তক্ষরণ, অগ্নিদগ্ধ রোগী, বড় ধরনের অস্ত্রোপচার, দুর্ঘটনাসহ আরও নানা কারণে রক্তের প্রয়োজন হয়। রক্তের এ চাহিদা পূরণে নতুন স্বেচ্ছায় রক্তদাতার কোনো বিকল্প নেই। সাধারণত ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী যে কোনো শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ সক্ষম ব্যক্তি প্রতি চার মাস পরপর রক্ত দিতে পারেন। স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের মাধ্যমেই হেপাটাইটিস নির্মূলের ২০৩০ সালের লক্ষ্য পূরণ করা সহজ হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, নিরাপদ রক্তপরিসঞ্চালন গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আক্রান্ত নারীদের জন্য এবং ম্যালেরিয়া বা অপুষ্টিজনিত কারণে তীব্র রক্তাল্পতায় আক্রান্ত শিশুদের জীবনরক্ষাকারী সহায়তা হিসেবে কাজ করে। নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে সন্তান ধারণের উপযুক্ত বয়সী নারী ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরাই সবচেয়ে বেশি রক্ত গ্রহণ করে। বিশ্বে সব দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নিরাপদ রক্তপরিসঞ্চালন একটি অত্যাবশ্যকীয় সেবা, যা জটিল চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার সফলে সহায়তা করে, রোগীর বেঁচে থাকার হার ও জীবনমান উন্নত করে। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন, যেসব রোগীর নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন হয়—যেমন, থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া, সিকল সেল অ্যানিমিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ঘটনা এবং আহত মানুষদের চিকিৎসার জন্যও রক্ত অপরিহার্য।
নিরাপদ রক্তের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হলে দেশে অবশ্যই স্বেচ্ছায় নিয়মিত রক্তদানের শক্তিশালী ভিত্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। একটি শক্তিশালী ও টেকসই রক্তদাতা কর্মসূচি, যেখানে সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে, তা রক্তের ক্রমাগত চাহিদা পূরণে সহায়ক। তবে অনেক দেশ এখনো রক্তের প্রাপ্যতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চ্যালেঞ্জের মুখে। অনেক ক্ষেত্রেই রোগীরা প্রয়োজনের সময় রক্ত পান না।
মন্তব্য করুন