আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ভোটের মাঠে আট দিনব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যাচাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানানো হয়েছে। গতকাল সোমবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ইসি সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও আট দিনের জন্য মাঠে নেমেছিল সশস্ত্র বাহিনী। তবে যাতায়াতের জন্য আরও পাঁচ দিন সময় নিয়েছিল। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১০ দিন মাঠে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে নির্বাচন ভবনে এ বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানসহ সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন।
বৈঠক শেষে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘মূলত পাঁচ দিনের ডেপ্লয়মেন্ট প্রোগ্রাম করা হয়। সেখানে একটা প্রস্তাব এসেছে, এটা যেন আট দিন করা হয়। নির্বাচনের আগে তিন দিন, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচন পরবর্তীকালে চার দিন। আমাদের ইনিশিয়াল প্রোগ্রামিং ছিল পাঁচ দিন। এখন প্রস্তাবনাটা আসছে, এটা আমরা পরীক্ষা করে দেখব।’
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাড়ে ৮ লাখ সদস্য মোতায়েন থাকবেন জানিয়ে ইসি সচিব বলেন, তাদের মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর ৯০ হাজার থেকে এক লাখ এবং দেড় লাখ পুলিশ সদস্য আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করবেন। তবে সবচেয়ে বড় বাহিনী হিসেবে থাকছেন আনসার ও ভিডিপির সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ সদস্য।’
বৈঠকে জুলাই আন্দোলনের সময় লুট হওয়ার অস্ত্রের ৮৫ শতাংশ উদ্ধার হয়েছে এবং অবশিষ্ট অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান এখনো চলমান রয়েছে বলে ইসিকে জানান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারে ড্রোন ব্যবহার করতে পারবেন না। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ড্রোন ব্যবহার করতে পারবে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে নানা মহল থেকে সংশয় প্রকাশ করা হচ্ছে। পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ইসির সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বৈঠকে বসে ইসি। বৈঠকে ১৩টি বিষয়ে আলোচনা হয় বলে প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। এর মধ্যে ছিল ভোটকেন্দ্র ও নির্বাচনী এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার পরিকল্পনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম সমন্বয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অবৈধ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য প্রতিরোধ, বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা, ডাকযোগে ভোটের (পোস্টাল ভোট) ব্যবস্থাপনা, সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা, পার্বত্য এলাকায় নির্বাচনী সরঞ্জাম পরিবহন, হেলিকপ্টার সহায়তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো।
দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, অবশ্যই নির্বাচন করার মতো পরিবেশ আছে।
বৈঠকে কেউ কোনো আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন কি না—এক সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, বৈঠকে অংশ নেওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিনিধিদের কারও মধ্যে কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি। বরং সবাই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এআই প্রযুক্তির ব্যবহারের বিষয়ে ইসি সচিব বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দুর্গাপূজার সময় এনটিএমসি প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে সফলভাবে ৩৫ হাজারের বেশি মণ্ডপ মনিটর করা হয়েছে, সে অভিজ্ঞতা নির্বাচনে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
তিনি জানান, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী নির্বাচনী সামগ্রী পরিবহনসহ দুর্গম এলাকায় সহায়তা দেবে বলে বৈঠকে আলোচনা হয়। নির্বাচনী এলাকায় সেনাবাহিনী ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে কি না, সে বিষয়ে আলোচনা চলছে।
সব বাহিনী তাদের নিজস্ব প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছে বলে বৈঠকে জানানো হয়, যাতে নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনে দক্ষতা ও সমন্বয় বাড়ে। নির্বাচনী তদারকি বাড়াতে বডি-অর্ন ক্যামেরা, ড্রোনসহ আধুনিক মনিটরিং ব্যবস্থাও থাকবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাজেট প্রসঙ্গে ইসি সচিব বলেন, এখনো বাজেট নির্ধারণ করা হয়নি, তবে প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনার খরচসহ প্রতিটি সংস্থা প্রস্তাব দেবে। ধাপে ধাপে আলোচনা করে বাজেট চূড়ান্ত করা হবে।
বৈঠকে আরও অংশ নেন সেনাবাহিনী প্রধানের প্রতিনিধি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম, নৌবাহিনী প্রধানের প্রতিনিধি রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী, বিমানবাহিনী প্রধানের প্রতিনিধি এয়ার ভাইস মার্শাল রুশাদ দিন আসাদ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবু মোহাম্মদ সরোয়ার ফরিদ, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, আনসার ও ভিডিপি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ, বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. জিয়াউল হক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল কাইয়ুম মোল্লা, র্যাব হেডকোয়ার্টার্সের মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক জি এম আজিজুর রহমান ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. ছিবগাত উল্লাহ।
মন্তব্য করুন