

দীর্ঘ ৯ মাস বন্ধ থাকার পর সরকার সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটক যাতায়াতের অনুমতি দিলেও এর বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়নি। ১ নভেম্বর ছিল সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচলের প্রথম দিন। কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে ছয়টি জাহাজ প্রস্তুত থাকলেও কোনো জাহাজ রওনা হয়নি।
পর্যটকদের রাতযাপন নিষিদ্ধ করা, নির্ধারিত সময়ের সীমাবদ্ধতা এবং অনলাইনে টিকিট সংগ্রহের বাধ্যবাধকতা—এসব কারণে পর্যটকদের আগ্রহ ছিল না বলেই মনে করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। এর প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারেও। পর্যটন মৌসুম শুরু হলেও সৈকতের বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি ছিল অনেকটাই ফাঁকা। কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ আলম বলেন, সেন্টমার্টিনে বিধিনিষেধ আরোপ করায় কক্সবাজারেও পর্যটকের সংখ্যা কমে গেছে।
ঢাকার নারায়ণগঞ্জ থেকে পরিবারসহ কক্সবাজার বেড়াতে আসা তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ভাবলাম বউ-বাচ্চা নিয়ে প্রথমবারের মতো সেন্টমার্টিন ঘুরে আসব। কিন্তু শুনলাম সকালে গিয়ে বিকেলেই ফিরতে হবে, দ্বীপে রাতে থাকা যাবে না। তাই আর ঝামেলায় গেলাম না। কক্সবাজার ঘুরেই বাড়ি ফিরব।’
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নীতিগত অনুমতির ভিত্তিতে সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াত চালু হলেও আইনগত কারণে ইনানী ঘাট থেকে জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ রয়েছে। কারণ, ইনানী এলাকা ‘প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)’ ঘোষিত।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন জানান, নুনিয়ারছড়া ঘাট থেকেই নিয়ম অনুযায়ী জাহাজ চলবে। ইনানী রুটে চলাচলের কোনো সরকারি অনুমোদন দেওয়া হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে পর্যটকেরা শুধু দিনে দ্বীপ ভ্রমণ করতে পারবেন। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে সীমিতভাবে রাতযাপনের অনুমতি থাকবে। ফেব্রুয়ারিতে পর্যটক প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ থাকবে। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২ হাজার পর্যটক যেতে পারবেন দ্বীপে। এ ছাড়া অনলাইনে কিউআর কোডযুক্ত টিকিট সংগ্রহ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
পরিবেশ রক্ষায় দ্বীপে পলিথিন, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক সামগ্রী, মোটরযান, সি-বাইক, শব্দ সৃষ্টি ও বারবিকিউ পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। কেয়াবনে প্রবেশ, সামুদ্রিক কাছিম, প্রবাল, শামুক-ঝিনুকের ক্ষতি করাও দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থেই কিছুদিন ভ্রমণ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। এখন দ্বীপটিকে স্থানীয় জনগণকেন্দ্রিক পর্যটনকেন্দ্রে রূপ দেওয়ার উদ্যোগ চলছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান বলেন, নুনিয়ারছড়া ঘাট থেকে ছয়টি জাহাজে প্রতিদিন ২ হাজার পর্যটক যাতায়াত করতে পারবেন। এজন্য একটি যৌথ কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা নিবন্ধন প্রক্রিয়া ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ তদারকি করবে। প্রশাসন পর্যটকদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে কাজ করছে।
তবে পর্যটন ব্যবসায়ীরা সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। স্কোয়াবের সাধারণ সম্পাদক হোসাইনুল ইসলাম বাহাদুর বলেন, ‘আমাদের ছয়টি জাহাজ প্রস্তুত। কিন্তু পর্যটকদের সাড়া নেই। সব মিলে ৪০ থেকে ৫০ জন পর্যটক হলে জাহাজ ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। সরকার যদি সিদ্ধান্ত না বদলায়, তাহলে জাহাজ চলাচল সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘সরকার সেন্টমার্টিনবাসীর সঙ্গে তামাশা করছে, আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।’
সেন্টমার্টিন দ্বীপের হোটেল সি-প্রবালের মালিক আবদুল মালেক বলেন, ‘কক্সবাজার থেকে জাহাজে দ্বীপে পৌঁছাতে বিকেল ৪টা বাজে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই আবার জাহাজে ওঠার তাড়া পড়ে। এভাবে ভ্রমণ হয় নাকি?’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের পর্যটনবিরোধী সিদ্ধান্তের ফলে দ্বীপের মানুষ না খেয়ে মরবে। অনেকেই এরই মধ্যে দ্বীপ ছেড়ে চলে গেছেন।’
সরকার বলছে, সেন্টমার্টিনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে পর্যটন খাতে কিছু নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়েছে। তবে এর সঙ্গে সমন্বয় রেখে পর্যটন উন্নয়নে সমন্বিত নীতিমালার কাজ চলছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পর্যটকদের চাহিদা ও পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য আনতে পারলে সেন্টমার্টিন আবারও হয়ে উঠবে দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র।
মন্তব্য করুন