আজাদ আলী জাতীয় চিড়িয়াখানায় মাহুত হিসেবে কাজ করেন। সেখানে হাতিগুলো দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলা দেখান, আনন্দ ছড়ান দর্শকের মাঝে। আনন্দ বিলিয়ে নিজেও আনন্দিত হন আজাদ। তবে তার মধ্যে এখন আর আনন্দ নেই। যে হাতি প্রায় পাঁচ বছর ধরে লালন-পালন ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন তিনি, সেই হাতির আছাড়ে প্রাণ গেল তার একমাত্র ছেলে জাহিদের। সবচেয়ে শান্ত হিসেবে পরিচিত ছিল হাতিটি। যাকে ডাকা হতো ‘রাজা’ নামে। গত ১১ এপ্রিল ঈদের দিন সকালে জাতীয় চিড়িয়াখানায় রাজার আক্রমণে মারা যায় জাহিদ।
ঈদের নামাজ, খাওয়া-দাওয়া শেষে অন্যদের সঙ্গে ছেলেকেও আনন্দ দিতে চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়েছিলেন আজাদ। ঘটনার সময় কিছুটা দূরে ছিলেন তিনি। এর মধ্যেই রাজা তার ছেলেকে আছড়ে মেরে ফেলে। ছেলের মৃত্যুতে নিজেকেই দুষছেন আজাদ। গতকাল সোমবার কথা বলার সময় আজাদ বারবার বলছিলেন, ‘নিজের হাতে মারাইছি আমি! কেন নিয়া গেলাম।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আজাদ জানান, দর্শনার্থীদের জন্য খেলা শুরুর আগে কসরত করানো হচ্ছিল। জাহিদ পাশেই ছিল। হাতির পিঠে বসা ছিল জাহিদের মামা। আর আজাদ গিয়েছিলেন টয়লেটে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাহিদকে ধরে ফেলে হাতিটি। ওপরে তুলে আছাড় দেয়, পা-মাথা দিয়ে আঘাত করে। মুহূর্তের মধ্যেই প্রাণ হারায় জাহিদ।
মাহুত আজাদ আলীর বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায়। স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে মিলে তার পরিবার। চিড়িয়াখানায় মাস্টাররোলে চাকরি করে পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে পারছিলেন না তিনি। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল জাহিদ। এরপর আর পড়া হয়নি। থাকত কুলাউড়ায়। দুই মাস আগে সিলেটের কুলাউড়া থেকে ১৭ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে জাহিদকে ঢাকায় নিয়ে আসেন আজাদ। চিড়িয়াখানার পাশে একটি ভবনে মিস্ত্রি হিসেবে কাজও শুরু করেছিল জাহিদ।
আজাদ জানান, বাবা-ছেলে মিলে ঈদের নামাজ পড়েন তারা। এরপর বাসায় খেয়ে ছেলেকে নিয়ে যান চিড়িয়াখানায়। ঢাকায় জাহিদের পরিচিত কেউ না থাকায় বাবার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় গেলে ওর ভালো লাগবে—এ আশায় ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক ড. মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার কালবেলাকে বলেন, চিড়িয়াখানার হাতিগুলোর মধ্যে এ হাতিটা ছিল সবচেয়ে শান্ত। কখনো কাউকে আক্রমণের রেকর্ড নেই; কিন্তু ওইদিন দুর্ঘটনা ঘটল। মাহুতেরই ছেলে মারা গেছে।
এ ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কর্তৃপক্ষ। এক সদস্যবিশিষ্ট কমিটিকে তিন কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়েছে। নিহত জাহিদের বাবা মাহুত আজাদ আলীর সঙ্গে কথা বলেছে তদন্ত কমিটি। চিড়িয়াখানায় ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা অন্যদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। রফিকুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনাটি কীভাবে হলো, কারও অবহেলা ছিল কি না–সব বিষয় তদন্তে উঠে আসবে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা আজাদ আলী। তিনি বলেন, হাজার হাজার মানুষের সামনে হাতি খেলা দেখাই, কাউকে কিছু করে না। আমার ছেলের বেলায় কেন এমন হলো!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আক্রমণ করা রাজা এশিয়ান হাতি হিসেবে পরিচিত। হাতিটি এখন চিড়িয়াখানায় থাকলেও জন্ম থেকে বেড়ে উঠেছে কুলাউড়ার এক মালিকের অধীনে। সেখানে এ হাতিকে ছোটবেলা থেকেই লালন-পালন করেছেন মাহুত আজাদ। তার বাবাও মাহুত ছিলেন। এখন আজাদের ভাই, স্ত্রীর বড় ভাই মাহুত হিসেবে কাজ করেন। মাঝে ১০ বছর হাতিগুলো ছিল সার্কাসে। তখন মাহুত হিসেবে ছিলেন অন্য একজন। উত্তরবঙ্গে সার্কাস দেখানো শেষে ঢাকায় এসে চাঁদাবাজি ও তাণ্ডব চালানোর অভিযোগে ২০১৯ সালে দুটি হাতিকে আটক করে র্যাব। এরপর হাতি দুটিকে জাতীয় চিড়িয়াখানার হেফাজতে দেওয়া হয়েছে। চিড়িয়াখানায় নেওয়ার পর আবার দেখভালের দায়িত্ব পান আজাদ। এ দুই হাতির একটির আক্রমণে মারা যায় জাহিদ।
আজাদ বলেন, হাতির মালিকের বাড়ি আমাদের গ্রামে। ওইখানে ছোটবেলা থেকে লালন-পালন করছি। মাঝে ১০ বছর আমার কাছে ছিল না। র্যাব ধরার পর ওরে শান্ত করে চিড়িয়াখানায় আমিই নিয়ে আসছিলাম। এরপর থেকে আমিই দেখভাল করি। আজ এ হাতিই আমার ছেলেকে কাইড়া নিল।