১৯৯৯ সালের ১৯ মার্চ। আমি তখন ইসলামাবাদে। আমার সঙ্গে ছিলেন ইউপিএলের স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন আহমদ। ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তখন আবদুর রহিম। অমায়িক ভদ্রলোক। ইসলামাবাদে এসে দেখা করেছি তার সঙ্গে। পাকিস্তানে এসেছি, কখন কী হয়। এই শঙ্কা ছিল না বললে ভুল হবে। তাই হাইকমিশনারকে জানানো। তিনি জানিয়েছিলেন, ১৭ মার্চ হাইকমিশনে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস পালন করা হবে। পাকিস্তানে আগে এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। তিনি না বললেও বুঝলাম ব্যাপারটা স্বাভাবিক। কারণ গত দুই দশক বঙ্গবন্ধুবিরোধীরাই ক্ষমতায় ছিল। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই পালিত হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবস ইত্যাদি। এক হিসাবে হাইকমিশনের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই প্রথম এ দিবসটি উদযাপিত হবে তাও পাকিস্তানে, আমন্ত্রিতরা কি আসবেন? আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন হাইকমিশনার। আমরা বললাম, অবশ্যই যাব। বিকেলে খুঁজেপেতে পৌঁছলাম হাইকমিশনে। ছোট হলঘরটি দেখলাম দর্শকে পরিপূর্ণ। হ্যাঁ, হাইকমিশনের স্টাফরা এসেছেন সপরিবারে। দুয়েকজন প্রবাসী বাঙালি যুবকও আছেন, কিছু পাকিস্তানিও আছেন। সামনের সারিতে বসে আছেন প্রফেসর আহমদ হাসান দানি, প্রাক্তন কেবিনেট সচিব হাসান জহির, ঢাকার প্রাক্তন কমিশনার আলমদার রাজা এবং আরও বেশ কয়েকজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুফিয়া আহমদকেও দেখলাম। উনি গবেষণার কাজে এসেছেন পাকিস্তান। আরও অনেকে আছেন যাদের চিনি না। সাংবাদিকও এসেছেন কয়েকজন।
অনুষ্ঠানে বক্তা পাকিস্তানিরাই। বেশ চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা। হাইকমিশনের প্রেস সচিব ভুল বাংলায় ভুল উচ্চারণে স্বাগত জানালেন সবাইকে। তারপর বক্তব্য রাখতে অনুরোধ জানালেন মালিক সরফরাজ আলিকে। তিনি ছিলেন পাঞ্জাব আওয়ামী লীগের সভাপতি। দেখতে শুনতে শেখ মুজিবের মতোই। ১৯৭১ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি আওয়ামী লীগের সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করলেন। বললেন, মুজিব লাহোরে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন। বলেছিলেন, আমি ভিক্ষা চাইতে আসিনি, আমি মানুষের, বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার চাইতে এসেছি। তার মানবিক গুণাবলি ছিল অসাধারণ।
সরফরাজ জানালেন, গত মাসে তিনি ঢাকা গিয়েছিলেন। ঢাকার মানুষ তাকে খাতিরযত্ন করেছে। সেখানে একজন তাকে বলেছিলেন, কায়েদে আজম ও বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেপারিটিস্ট। সরফরাজ বললেন, হতে পারে কিন্তু শেষোক্তজন ফাইট করেছিলেন অধিকার আদায়ের জন্য।
তারপর বক্তৃতা দিতে উঠলেন ড. তারিক রহমান। ইসলামাবাদের কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এর কথাই আমাকে আহমেদ সেলিম বলেছিলেন, যিনি ১৯৭১ সালে সামরিক বাহিনী ত্যাগ করেছিলেন। সৌম্য শান্ত চেহারা। পিএইচডি করেছেন পাকিস্তানের ভাষা ও রাজনীতির ওপর। বই আকারে তা প্রকাশ করেছে অক্সফোর্ড। সেই বইয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আমাদের ভাষা আন্দোলন।
ড. রহমান প্রধানত বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বের ওপর জোর দিলেন। তিনি বললেন, ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষা আন্দোলন ছিল না, অধিকারের লড়াইও ছিল, যা শাসকরা অনুধাবন করেনি। ‘দে হ্যাভ গট দেয়ার লেসন, উই হ্যাভ গট আওয়ার লেসন। লেটস লিভ অন ইক্যুয়াল বেসিস।’
এরপর অধ্যাপক আহমদ হাসান দানিকে আহ্বান জানানো হলো কিছু বলার জন্য। অধ্যাপক দানি আমাদের পরিচিত মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন। লিখেছেন ঢাকার ইতিহাস, গড়ে তুলেছেন জাতীয় জাদুঘর ও এশিয়াটিক সোসাইটি। অধ্যাপক দানি অমায়িক মানুষ। আমি তাকে দেখছি গত এক দশক ধরে। কোনোদিন তাকে ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ হতে দেখিনি। কিন্তু আজ এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
অধ্যাপক দানি গম্ভীরভাবে বক্তৃতা শুরু করলেন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, ঢাকা শহর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিচারণ করলেন। বললেন, বাঙালিরা তাকে সবসময় নিজের লোক মনে করেছে। তিনি সেখানে থেকেছেন, তাদের ভাষা শিখেছেন এবং যত আন্দোলন হয়েছে তাও দেখেছেন। কারণ তার বাসা ছিল নিমতলী কুঠিতে। আর সব আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শহীদ মিনার।
ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। ড. তারিক রহমানের কথার প্রতিধ্বনি করলেন দানি। তারপর দেখা গেল তার গলার স্বরে ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছে। বললেন, ‘বাঙালিদের কি পাকিস্তানিরা মানুষ মনে করেছে? আমার খেয়াল আছে, রেভিনিউ সেক্রেটারি ইকরাম একদিন আমাকে বললেন, বাঙালি মেয়েরা টিপ দেয় কেন? বললাম, এটি প্রাগৈতিহাসিক ঐতিহ্য। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ প্রথা চালু আছে। তারপর ইকরামকে বললাম, তোমরা সালোয়ার-কামিজ পরো কেন? এই সালোয়ার-কামিজ পরাটাকেও তো এখানকার লোকেরা ঘৃণা করতে পারে। পুরো হলে পিনপতন নিস্তব্ধতা। অধ্যাপক দানির গলার স্বর উঁচু গ্রামে উঠছে, ক্রোধ, ক্ষোভ ফুটে উঠছে। তার রক্তিম চেহারা রক্তবর্ণ হয়ে উঠছে। এ অধ্যাপক দানি আমাদের অচেনা। কী কারণে যেন আজ তার সব ক্ষোভ ফেটে পড়ছে। বললেন, ‘পাকিস্তানের মানুষজন এগুলো বোঝেনি। ঢাকায় থাকার সময় ভাবতাম, বাঙালিরা কীভাবে এসব পশ্চিমা অফিসারের খারাপ ব্যবহার সহ্য করে? আমি ঢাকায় থাকতাম। বাঙালিরা আমার বন্ধু। সে কারণে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেও পাকিস্তানি অফিসাররা দ্বিধা করেনি! এ ধরনের ব্যবহারের অসহ্য হয়ে উঠলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি ছেড়ে দিই। আমাকে ভিসি জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন চলে যাচ্ছেন? আমি বলেছিলাম, ইস্ট পাকিস্তান পাকিস্তানের সঙ্গে থাকবে না। বাঙালিরা ন্যায্য বিচার চেয়েছিল। তাদের তা দেওয়া হয়নি এবং এর জন্য দায়ী আমলারা, যাদের অনেকে এখানে উপস্থিত আছেন—বলে নাটকীয় ভঙ্গিতে সামনের সারিতে বসা প্রাক্তন আমলাদের দেখালেন ড. দানি। সবাই স্তম্ভিত।
না, এ বলেও থামেননি অধ্যাপক দানি। পুরোনো কথার সূত্র ধরে তিনি বললেন, ‘পাকিস্তানি আমলাদের মানবিকতা ছিল না। কয়েক দিন আগেও এ বিষয়ে আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, পত্রিকা তা ছাপেনি। শেখ মুজিব ন্যায়বিচার, সাম্য ও মানবিক আচরণ চেয়েছিলেন। নির্বাচনে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন। তাকে ক্ষমতা দেওয়া হবে না কেন? মুজিব বাঙালিদের সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার ছিনিয়ে আনতে সফল হয়েছিলেন।’
প্রায় মিনিট কুড়ি বললেন অধ্যাপক দানি। এত সুন্দর, আবেগী বক্তৃতা খুব কমই শুনেছি। পরে দর্শকরাও একই কথা বলেছেন এবং জানিয়েছেন, ড. দানির এ চেহারার সঙ্গে তারা পরিচিত নন। ড. দানি বক্তব্য শেষ করলেন এভাবে—‘আমি শকড। বাঙালিরা কেন শেখ মুজিবকে দেশ গড়তে দিল না। কেন তাকে সহ্য করল না?’
তারপর হাসান জহির বক্তব্য রাখার কথা। তিনি জানালেন, তিনি বলবেন না। আরও দুয়েকজন প্রাক্তন আমলার বোধহয় বক্তব্য রাখার কথা ছিল। কিন্তু অধ্যাপক দানির বক্তৃতার পর কেউ আর বক্তৃতা দিতে রাজি নন। এমন সময় আলমদার রাজার স্ত্রী অ্যাডভোকেট আনোয়ার রাজা নিজে থেকেই মঞ্চে উঠে এলেন। তিনি তার স্মৃতিচারণ করলেন। বললেন, ‘বাংলাদেশে আমি আমার জীবনের সাতটি সুন্দর বছর কাটিয়েছি যার মধুর স্মৃতি ভোলার নয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রায় যদি শাসকরা মেনে নিতেন, তাহলে আজ পাকিস্তানের ইতিহাস অন্যরকম হতো।’
লেখক : বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন