বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে ব্যাংক খাতের উপর মানুষের আস্থার সংকট চরম আকার ধারণ করেছিল। আতঙ্কিত হয়ে মানুষ ব্যাংকে রাখা তুলে নিয়ে বাসায় রাখতেন।
এতে করে ব্যাংকগুলোতে দেখা দেয় চরম তারল্য সংকট। এমন অবস্থায় ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ শুরু করে। কিন্তু এতেও কাজে আসেনি। প্রতি মাসেই বাড়ছিল মানুষের হাতে নগদ টাকা তথা ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ। গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত মানুষের হাতে নগদ টাকা বা ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল।
তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর ব্যাংক খাতের উপর মানুষের আস্থা পুনরায় বাড়তে থাকে। পরের মাস সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংকে ফিরতে শুরু করে মানুষের হাতে রাখা টাকা। যেটার ধারাবাহিকতা চলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। পরের মাস মার্চে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ আবার বেড়েছে।
অর্থাৎ ব্যাংক থেকে মানুষ টাকা বেশি তুলে নিয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৯৩৬ কোটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুুলে নেওয়ার পর যা আর ব্যাংকে ফেরত আসে না, তা-ই ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকা হিসেবে পরিচিত। মূলত মার্চ মাসে ঈদুল আজহার সময় মানুষ টাকা বেশি তুলেছেন। ধীরে ধীরে এসব অর্থ ফের ব্যাংকে ফিরবে বলেও জানান তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকেই মানুষের হাতে নগদ বা ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ কমতে থাকে। গত বছরের আগস্টে মানুষের হাতে বা ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি ৪ লাখ টাকা।
আর পরের মাস সেপ্টেম্বরে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫৩ কোটি ৪ লাখ, পরের মাস অক্টোবরে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি ৭ লাখ, পরের মাস নভেম্বরে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৫৬ কোটি ৭ লাখ, পরের মাস ডিসেম্বরে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭১ কোটি ৫ লাখ, চলতি বছরের জানুয়ারিতে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৪ হাজার ২৩০ কোটি ৯ লাখ এবং ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭১ হাজার৪৯৫ কোটি ৬ লাখ টাকা।
আর চলতি বছরের মার্চে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩১ কোটি ৬ লাখ টাকা। তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ধারাবাহিক কমছিল ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ। কিন্তু নভেম্বর থেকে আবার বাড়তে শুরু করে। যেটা গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। পরের মাস নভেম্বরে সেটা বেড়ে দাড়ায় ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, ডিসেম্বরে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি, জানুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৯৫ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি, মার্চে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি, এপ্রিলে বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি, মে মাসে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি, জুনে ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩৬ কোটি, জুলাইয়ে ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৩০ কোটি ও আগস্টে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি ৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ দশ মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়েছে ৪৬ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের খরচ বেশি হয়। এজন্য বাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখে। তারপর ব্যাংক খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে কিছু ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থায়ও নষ্ট হয়েছিল। মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছিল। এখন আস্থায় ফেরায় মানুষ আবার ব্যাংকে টাকা রাখছে।
এদিকে, মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি বাজারে মুদ্রা সরবরাহ’র পরিমাণও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক খাতে ছাপানো টাকার স্থিতি (রিজার্ভ মানি) ছিল ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬০২ কোটি ৯ লাখ টাকা। আর পরের মাস অর্থাৎ চলতি বছরের মার্চে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ কোটি ৬ লাখ টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসে মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে ২৮ হাজার ১৩০ কোটি ৭ লাখ টাকা।
মন্তব্য করুন