

কন্যাসন্তানের গায়ের রঙ সাধারণ বাঙালিদের মতো নয়। তাই স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন স্বামী মোজাফফর হোসেন। অভিযোগ তুলেছেন এই সন্তান তার নয়। সেজন্য তার দায়-দায়িত্বও নিতে পারবেন না তিনি।
ঘটনাটি যশোর সদর উপজেলার বাউলিয়া চাঁদপাড়া গ্রামের।
জানা যায়, ২০২০ সালে পারিবারিক ভাবে মোজাফফরের সঙ্গে বিয়ে হয় কুয়াদা বাজুয়াডাঙ্গা পশ্মিমপাড়া গ্রামের মনিরা খাতুনের। এরপর ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর এই দম্পতির ঘর আলো করে আসে একটি কন্যাশিশু। তবে শিশুটি দেখতে আর পাঁচটা বাচ্চার মতো না হওয়ায় স্ত্রী ও কন্যাশিশুকে ত্যাগ করে প্রবাসে চলে যান স্বামী মোজাফফর। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মনিরা খাতুনকে তালাক দেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী এই নারীর।
সদর উপজেলার কুয়াদা বাজুয়াডাঙ্গা পশ্মিমপাড়ায় মনিরা খাতুনের খোঁজে গিয়ে দেখা যায়, সাদা ধবধবে একটি কন্যাশিশুকে নিয়ে বসে আছেন শ্যামলা বর্ণের এক নারী। ছোট্ট শিশুকে অক্ষরজ্ঞান শেখাচ্ছেন মনিরা। আর তার পাশে বসে ‘অ তে অজগর’ পড়া ছোট্ট শিশুটির নাম আফিয়া।
তিন বছর বয়সী আফিয়া বেশ দুরন্ত। তবে বাবার কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে সে আর কথা বলে না, এমনটা বলছিলেন মনিরা। তিনি জানান, অভাবের সংসার আর সৎ মায়ের ঘরে বড় হয়েছেন। বিয়ের পর নতুন জীবন ফিরে পাবেন, এমনটাই আশা ছিল। তবে কন্যাসন্তানের ‘গায়ের রঙ’ তার সেই স্বপ্ন ভেঙেছে।
মনিরা বলেন, আফিয়া জন্মের পরপরই ওর বাবা আমাকে নানা অপবাদ দিতে শুরু করে। মেয়ে তার নয়। আমার অন্য কারও সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক ছিল। আমি বারবার বলেও তাকে বোঝাতে পারিনি। আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। পরে ৭ থেকে ৮ মাস পর আমাকে তালাক দিয়ে দেয়। এরপর আমার বা আমার মেয়ের কোনো খোঁজ নেয়নি।
তিনি বলেন, এই ভাঙা ঘরে মেয়েকে নিয়ে অনিরাপদ জীবন যাপন করছি। লোকের বাড়ি কাজ করে কোনো রকম বাচ্চাটার খাবার জোগায়। কোনো অপরাধ না করেও আমি আর আমার সন্তান শাস্তি পাচ্ছি।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ২০২৪ সালের ২১ মে স্থানীয়দের সহযোগিতায় একটি সালিশ হয়। সে সময় স্বামী মোজাফফরের পক্ষে তার বড় ভাই আবু বক্কর আফিয়ার খরচ বাবদ প্রতি মাসে ১ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু দুবছর পার হলেও কোনো টাকা দেননি।
বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা করেও সমাধান হয়নি বলে জানান রামনগর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আব্দুল গফুর মোল্লা। তিনি বলেন, শুধু সন্তানের গায়ের রঙ ভিন্ন থাকায় স্ত্রী ও কন্যাকে ত্যাগ করেন মোজাফফর। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়ভাবে কয়েক দফা মীমাংসার চেষ্টা করেছি। একটা সমঝোতা হয়েছিল। কিন্তু পরে মোজাফফরের পরিবার সেই কথা রাখেনি বলেও অভিযোগ রয়েছে।
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. গোলাম মোর্তজা আফিয়ার প্রাথমিক তথ্য ও ছবি দেখে নিশ্চিত করেন এটি কোনো রোগ নয়।
তিনি বলেন, দেশে এমন বর্ণের অনেক মানুষ রয়েছে। এটি সাধারণত পিতার জিনগত ত্রুটি। যার প্রভাব বাচ্চার ওপর পড়ে। তবে এমন শিশুদের চোখের সমস্যা থাকতে পারে। রোদে গেলে শরীরে এলার্জি বা চুলকানি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বিষয়টি জানার পর আফিয়ার পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন রামনগর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান রামপ্রসাদ রায়। ঘটনাটি জানার পর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আফিয়ার মা মনিরার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
রামপ্রসাদ রায় বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। বর্তমান সময়ে এসে কোনো মানুষ এমন অমানবিক কাজ করতে পারে না। আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সাধ্যমতো পরিবারটিকে সহযোগিতা করব। একই সঙ্গে গ্রাম আদালতে অভিযোগ দিলে ভরণপোষণের বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
এদিকে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও অভিযুক্ত মোজাফফরের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে তার বড় ভাই আবু বক্কর জানান, মোজাফফর দেশে নেই। আফিয়া ও তার মায়ের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, আগে একবার সালিশ করে সমাধান হয়ে গেছে।
যশোরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, এই জেলার কোনো নাগরিক যদি গৃহহীন বা সমস্যায় থাকে, তা আমাদের করণীয়ের মধ্যে পড়ে। বিষয়টা খোঁজ নিয়ে তার আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। থাকার ব্যবস্থাও করা হবে।
মন্তব্য করুন