নূর হোসেন মামুন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘সংসদ সদস্য হতে চাওয়ায়’ খুন, ২২ বছরেও শেষ হয়নি বিচার

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন চৌধুরী। ছবি : কালবেলা
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন চৌধুরী। ছবি : কালবেলা

২০০৩ সালের ২৪ জুলাই রাত, চট্টগ্রাম নগরের চকবাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বাসায় ফেরার পথে অপহরণের শিকার হন দক্ষিণ জেলা বিএনপির তৎকালীন সহসভাপতি জামাল উদ্দিন চৌধুরী। দাবি করা হয় ৫০ লাখ টাকার মুক্তিপণ। তবে অপহরণকারীদের ২৫ লাখ টাকা দিলেও মুক্তি দেওয়া হয়নি সেই বিএনপি নেতাকে। এরপর কেটে যায় টানা দুই বছর। ২০০৫ সালের ২৪ আগস্ট, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির পাহাড়ি এলাকা থেকে কঙ্কাল উদ্ধার করে র‍্যাব।

সিঙ্গাপুরে করা ডিএনএ পরীক্ষায় বের হয়ে আসে, উদ্ধার হওয়া সে কঙ্কালটি অপহরণের শিকার বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের। তার বাড়ি আনোয়ারা উপজেলায়।

পরিবারের দাবি, সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনের জন্য বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাওয়ায় খুন করা জামালকে। আসামিদের জবানবন্দি এবং তদন্তে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির কয়েকজন নেতার সংশ্লিষ্টতা উঠে আসে। তবে জবানবন্দিতে নাম আসা বিএনপির এসব নেতাসহ ২৪ জনকে বাদ দিয়েই আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা। যার কারণে অভিযোগপত্রের ওপর নারাজি দেন বাদী।

তবে আদালত সেটি খারিজ করেই মামলার বিচার শুরু করেন। হত্যাকাণ্ডটির ২২ বছর পার হলেও সেই বিচার শেষ হয়নি। এখন নতুন করে সেই মামলা ফের তদন্ত করে বিচার শুরু করা হোক।

আইনজীবীরা জানান, বাদী অধিকতর তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করতে পারেন। মামলার সাক্ষ্য চলাকালে এর আগে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, চট্টগ্রাম বন্দরে কোকেন জব্দের মামলাসহ বেশ কিছু আলোচিত মামলা অধিকতর তদন্তে গিয়েছিল।

জামাল উদ্দিন হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম-১৩ আসনে দল মনোনীত প্রার্থী সরওয়ার জামাল নিজাম জানান, তদন্তে আমার নাম উঠে আসেনি। এগুলো আওয়ামী দোসরদের ষড়যন্ত্র।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ষষ্ঠ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটির বিচার চলছে। তদন্তে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় নাম আসা ব্যক্তিদের অনেকেই অভিযোগপত্র থেকে বাদ পড়ায় মামলাটির বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন মামলার বাদী ও নিহত ব্যক্তির ছেলে চৌধুরী ফরমান রেজা লিটন। তাই তিনি হাজির হচ্ছেন না সাক্ষ্য দিতে।

আদালত সূত্র বলছে, অপহরণের পর এটিকে সাজানো নাটক মন্তব্য করে প্রথমে মামলা নেয়নি পুলিশ। পরে পরিবারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুই বছর পর অপহরণের ‘অন্যতম হোতা’ আনোয়ারা সদরের সাবেক ইউপি সদস্য মো. শহীদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জেলার ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর পাহাড়ি এলাকা থেকে ২০০৫ সালে জামাল উদ্দিনের কঙ্কাল উদ্ধার করে র‍্যাব।

আসামি শহীদুল ইসলাম ও মাহবুব আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জামাল উদ্দিনকে অপহরণ ও হত্যার পুরো বিষয়টি উঠে আসে। এতে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে ২৫ লাখ টাকা গ্রহণ ও অপহরণে কারা কারা জড়িত, সবার নাম আসে।

জানা যায়, ২০০৫ সালের ৩১ আগস্ট জবানবন্দিতে শহীদুল বলেন, ‘জামাল উদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাই। পরে মোবাইল ফোনে বলে ২৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথাবার্তা হয়েছে।

এদিকে ওই ঘটনা সাড়ে তিন বছর তদন্ত করেন পুলিশের ৯ কর্মকর্তা। এরপর ২০০৬ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আনোয়ারার সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম (বর্তমানে ওই আসনে বিএনপির প্রার্থী), তার ছোট ভাই মারুফ নিজামসহ ২৪ জনকে অব্যাহতি দিয়ে ও ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেয়। পরে এর বিরুদ্ধে নারাজি দেন বাদী।

মামলার আসামি মাহবুবকে রাজসাক্ষী করায় আপত্তি জানিয়ে মারুফ নিজাম উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নেন ২০০৭ সালে। ২০১১ সালে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে লিভ টু আপিল করেন আসামিরা। এটি খারিজের আদেশ চট্টগ্রাম আদালতে এসে পৌঁছায় ২০১৬ সালে।

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালত সিআইডির দেওয়া (২০০৬ সালে) অভিযোগপত্র গ্রহণ করে বাদীর নারাজি আবেদন খারিজ করে দেন। এরই মধ্যে মারা যান দুই আসামি। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এ মামলার বিচার শুরু হয়।

আদালত সূত্র জানায়, বর্তমানে মামলাটির ৮৪ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ২৯ অক্টোবর সাক্ষী না আসায় আগামী বছরের ৩০ মার্চ মামলার পরবর্তী তারিখ রয়েছে। মামলার ১৪ আসামির মধ্যে শহীদুল ইসলাম, আবুল কাশেম চৌধুরী, মাহবুবসহ ১০ জন জামিনে রয়েছেন। কারাগারে রয়েছেন রফিক নামের এক আসামি। পলাতক রয়েছেন মো. মনসুর, মো. ওসমান, ইছহাক ও ইউনুস।

নিহত জামাল উদ্দিনের স্ত্রী নাজমা আক্তার বলেন, ২২ বছরেও স্বামীর হত্যার বিচার শেষ না হওয়ায় আমরা হতাশ। বাবার হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেননি আমাদের ছোট ছেলে চৌধুরী আরমান রেজা। গত সেপ্টেম্বর মাসে সে মারা গেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মূল আসামিরা আঁতাত করে পার পেয়ে গেছেন। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। বিএনপি নেতা সরওয়ার জামাল নিজাম, তার ভাই মারুফ নিজামসহ জড়িত ব্যক্তিদের নাম গ্রেপ্তার আসামিরা জবানবন্দিতে বলেছেন। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাওয়ায় আমার স্বামীকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মামলার বাদী জামাল উদ্দিনের ছেলে চৌধুরী ফরমান রেজা লিটন কালবেলাকে বলেন, বাবাকে অপহরণ, কঙ্কাল উদ্ধার, তদন্ত, নারাজি আবেদনের শুনানি স্থগিতাদেশসহ আইনি মারপ্যাঁচে ১৪ বছর ধরে আমি থানা-পুলিশ, আদালত ও প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। আট বছর ধরে মামলার খোঁজ নিতে আর আদালতে যাই না। মূল আসামিরা কেউ নেই। তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। বারবার নারাজি দিয়েছি, শেষ পর্যন্ত পারিনি। তাই আদালতে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

ফরমান রেজার দাবি, আসামির জবানবন্দি ছাড়াও সবাই জানে কারা, কেন আমার বাবাকে মেরেছে। সরওয়ার জামাল নিজামের সঙ্গেই আমার বাবার মতপার্থক্য ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমাকে তিনটি মামলার আসামি করা হয়। ভয়ে তখন কিছু করতে পারিনি। আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে মামলাটি আবার তদন্তে পাঠানোর আবেদন করা হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিপিএলে পাকিস্তানি তারকাদের উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা

সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি

ব্যবসায়ীকে গুলি করে টাকার ব্যাগ ছিনতাই

নতুন কর্মসূচি ঘোষণা বিএনপির

খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে প্রস্তুত কাতার

‘সংসদ সদস্য হতে চাওয়ায়’ খুন, ২২ বছরেও শেষ হয়নি বিচার

ভুলেও প্রেশার কুকারে রান্না করবেন না যেসব খাবার

দেশে কত দামে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে আজ

ভারত সফরে আসছেন পুতিন, লক্ষ্য সম্পর্ক জোরদার

মার্ভেল ছেড়ে ডিসিতে স্কারলেট?

১০

আজ ২০২৫ সালের শেষ পূর্ণিমা

১১

একই স্থানে বারবার ভূমিকম্পের কারণ জানা গেল

১২

বিদ্যালয়ের তালা ভেঙে পরীক্ষা নিলেন ইউএনও

১৩

যতবার করি, টাকা নিই ডার্লিং: শাহরুখ

১৪

মেঘলার ১২ বাস আটক ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের

১৫

বেগম জিয়ার অবস্থা অপরিবর্তিত : রিজভী

১৬

চা দোকানিকে গলা কেটে হত্যা

১৭

অবস্থার অবনতি, লাইফ সাপোর্টে অভিনেতা তিনু করিম

১৮

শীতে ওষুধ ছাড়া হাঁটুর ব্যথা কমানোর সহজ উপায়

১৯

ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনতে চাচ্ছেন? থাকছে কিছু টিপস

২০
X