বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পিত এবং সর্ববৃহৎ শিল্পনগর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরী মীরসরাই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মীরসরাই থেকে ১০ কি.মি. পশ্চিমে এবং চট্টগ্রাম শহর থেকে ৬০ কি.মি, উত্তরে অবস্থিত এই শিল্প নগরী। চট্টগ্রামের মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, ফেনীর সোনাগাজী এবং নোয়াখালির কিছু অংশ ছুঁয়ে যাওয়া এই শিল্প নগরীর বিস্তৃত প্রায় ৩৫ হাজার একর জায়গা জুড়ে। সন্দীপের ১৩ হাজার একর এবং নোয়াখালির কোম্পানীগঞ্জের পাঁচ হাজার জায়গাও ভবিষ্যতে এই শিল্পনগরীর সাথে যুক্ত হবে বলে জানিয়েছে বেজা। সাগরের বুকে জেগে ওঠা চরে বিশাল শিল্পাঞ্চল তৈরির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার দিকে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। এই শিল্পনগরীর ধারণা আমাদের ধারণারও অতীত।
বিশাল এই এলাকা বালি দিয়ে ভরাট করে তৈরি হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন সড়ক এবং শিল্পকারখার অবকাঠামো। বিগত সাত বছরের কর্মযজ্ঞে এই শিল্পাঞ্চলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৫১টি প্রতিষ্ঠানকে। বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। পর্যায়ক্রমে এই শিল্পনগরীতে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ হবে বলে দৃঢ়তার সাথে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশি বিদেশি বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানা ইতোমধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এশিয়া পেইন্ট, বার্জার, এ সি আই, বি এস আর এম, বসুন্ধরা ক্যামিক্যাল, ভারতীয় মার্কো ইত্যাদি। এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড) ৪৩টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজ শুরু করেছে। কিছু ভবনের নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এসব কিছুর জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে দ্রুত এগিয়ে চলছে পাওয়ার স্টেশন নির্মাণ কাজ। বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। আরও সড়ক তৈরির কাজ অব্যাহত রয়েছে।
ফেনীর সোনাগাজি থেকে মীরসরাইয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘেঁষে তৈরি হবে মেরিন ড্রাইভ, যা এখান থেকে কক্সবাজারের মেরিনড্রাইভ এর সাথে যুক্ত হবে। এতে যোগাযোগ হবে যেমন সহজ ও অবারিত তেমনি পর্যটনের জন্য হবে আকর্ষণীয়। চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, ফেনী জেলা সংযুক্ত এই বিশাল এলাকায় অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সাথে সাথে যোগাযোগ ও পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দরজা খুলে যাবে। শিল্প কারখানা তৈরির কর্মযজ্ঞ, দৃষ্টিনন্দন সড়ক, নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ,অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য-সবমিলে অত্যাধুনিক এই শিল্প অঞ্চলের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ আজ সবার। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী হবে দেশের প্রথম পরিবেশ শিল্প শহর বা ‘সবুজ’ শিল্প শহর। এখানে জ্বালানি ব্যবস্থাপনা এবং বর্জ্য ব্যবস্থনার সঙ্গে থাকবে সামঞ্জস্য।
সাগরের তীরঘেঁষা এই মীরসরাই শিল্পনগরীতে নির্মাণ হবে একটি নৌবন্দর। যার সম্ভাব্যতার কাজ শেষ হয়েছে। দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে জাপানের একটি কোম্পানি এই বন্দর নির্মাণ করবে। এখানে ছোট ও মাঝারি ধরনের জাহাজ ভিড়তে পারবে । আগামী এক দশকের মধ্যে এটি হবে একটি মেগাসিটি। এখানে থাকবে বিমানবন্দর, ডজন খানেক ৫ তারকা হোটেল। এছাড়াও স্কুল-কলেজ, অত্যাধুনিক হাসপাতাল,ফায়ার স্টেশন, নিরাপত্তার জন্য পুলিশ স্টেশন। ব্যাংকিং খাত সহজ করার জন্য দেশি বিদেশি ব্যাংকগুলোর থাকবে পূর্ণ সুযোগ সুবিধা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া মীরসরাইয়ে এই শিল্প নগরীর তীর ঘেঁষে থাকছে মেরিনড্রাইভ, যা ফেনীর সোনাগাজী থেকে শুরু হবে এবং কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের সাথে সংযুক্ত থাকছে। এর সাথে যুক্ত হবে রেল যোগাযোগ। শিল্প, কর্মসংস্থান, যোগাযোগে, পর্যটনের সমন্বিত এই মহা রূপকল্প দাবিত হচ্ছে সমৃদ্ধ ও স্মার্ট এক বাংলাদেশের দিকে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পাল্টে দেবার এই বিশাল কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রস্থল চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের ইছাখালি। সমৃদ্ধ জীবন এবং ঐতিহ্যের ধারক ‘ইছাখালি’ একটি ইউনিয়ন হলেও মূলত এর আকারে একে একটি উপজেলা বলা যেতে পারে। এই এলাকার মানুষের পরিচয়ের মধ্যে ফুটে ওঠে আভিজাত্য ও গৌরব। কার কত পরিমাণ ভূমি আছে ,মহিষের বাথান আছে, গরুর খামার আছে, ভেড়া-ছাগলের পাল পাল আছে-এই নিয়েই তাদের পরিচয়। এখানকার স্থানীয় বাজার মাদবার হাঁট, ঝুলনপোল বাজার, আবুর হাঁট, টেকের হাঁট, ভাঙনি, চর শরৎ, ভূইয়া রাস্তার মাথা ইত্যাদিতে ‘ভূমি লর্ড’দের আড্ডা বসে। তাদের আড্ডারি বিষয়বস্তু কে কত মণ ধান পেয়েছে, কত মণ খেসারীর ডাল হয়েছে, কার কত মণ মুগ মশুর, কলাই, ধইন্যা হয়েছে।
তাদের আড্ডায় আরও থাকে মহিষের বাথানে কার কতটি মহিষ আছে, খামারে কতটি গাভি দুধ দেয়, আগামী কোরবানি কতটি ষাড়-বলদ বিক্রি হবে, কার কত শত ভেড়া আছে ইত্যাদি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কার কত তরমুজের চাষা হয়েছে, এ পর্যন্ত কত লক্ষ টাকার তরমুজ বিক্রি হয়েছে। মহিষের দুধ ও দইয়ের জন্য ইছাখালির সুনাম সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। এছাড়াও এখানকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অন্যতম ভিত্তি স্থানীয় মৎস্য খামার। কার মৎস্য খামারে কত কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে এবং এই পর্যন্ত কত টাকা বিক্রি হয়েছে-এসব হচ্ছে এখানকার মানুষদের আলোচনার অতীব সাধারণ বিষয়। পারস্পরিক দেখা সাক্ষাতের এই আলোচনা ইছাখালির মানুষের প্রাত্যহিক জীবনেরই অংশ। সাধুর চর, চর নিলাক্ষী, চর শরৎসহ এসব এলাকার বিস্তীর্ণ জমির মালিক ইছাখালিসহ আশ-পাশের মানুষ জনের। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে ঠুকতো অজুহাত দেখিয়ে শত শত একর জমি শিল্পজোন গ্রাস করে নিচ্ছে। হুমকির মুখে আছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মিঠা পানির মৎস্য জোনটিও।
একসময় ফেনী নদীর করাল গ্রাসে শত শত একর জমি এক সময় বিলীন হয়ে যায়। ১৯৮৩-৮৪ ইংরেজি সনে ফেনী নদীর বুকে তৈরিকৃত মীরসরাই-সোনাগাজী মুহুরীপ্রজেক্ট। এর ইতিবাচক প্রভাবে পলি জমে বিলীন হওয়া এসব জমি চর হিসেবে আবার জেগে ওঠে। পূর্বের মালিকরা জেগে ওঠা চরে তাদের জমির পূন সীমানা নির্ধারণ করে চাষাবাদ শুরু করে । মাইলের পর মাইল সবুজ তৃণ ভূমিতে গড়ে ওঠে শত শত গরু, মহিষ, ভেড়ার খামার। মৌরসি এসব জমিতে কৃষি ভিত্তিক আয়ের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি প্রেক্ষিতে এই অঞ্চলের লোকজন চাকুরির প্রতি ছিল সর্বদাই বিমুখ। কৃষিভিত্তিক সমৃদ্ধ অর্থনীতির কারণে ইছাখালি এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষজন বরাবরই ছিল আত্মনির্ভরশীল। কিন্তু তাদের মেরুদণ্ড আজ ভেঙে দিচ্ছে এই শিল্পজোন। আরএস, পি এস রেকর্ড ঠিক থাকলেও নদী সিকস্তির কারণে অধিকাংশ এসব জমির বিএস রেকর্ড হয়নি। যার ফলে এসব জমিকে খাস হিসেবে খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে বিনামূল্যে গ্রাস করে নিচ্ছে শিল্পজোন।
অপরদিকে সরকার চড়া দামে এসব জায়গা বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করছে। কিন্তু জমির প্রকৃত মালিক তাদের দিকে কারো কোনো নজর নেই। যার ফলে যারা এক সময় ‘ল্যান্ড লর্ড’ ছিল তারা এখন হয়ে যাচ্ছে ভূমিহীন। ভেঙে পড়ছে সমৃদ্ধ কৃষি অর্থনীতি। বিলীন হয়ে যাচ্ছে এখানকার সংস্কৃতি কৃষি খামার। এদিকে কয়েক হাজার একর জমিতে এখানকার সাধারণ মানুষের উদ্যোগে গড়ে ওঠা মৎস্য জোনের মালিকরাও খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছে। একই অজুহাতে এসব মৎস্য জোনও শিল্প জোনের অধিকারে চলে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে এখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের চাকরির ব্যাপক সুযোগ হওয়ার কথা থাকলেও এখন তা হচ্ছে না। যে-সব শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদনের গেছে সেই সব প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতার ঘাটতি দেখিয়ে স্থানীয়দের চাকরির পথ অনেকটা রুদ্ধ। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি পাল্টে দেবার মতো এরকম একটা শিল্পনগরী যাদের বুকের উপর প্রতিষ্ঠিত তারাই হয়ত ভবিষ্যতে কাগজ কুড়োবে এবং পান-বিড়ির টং দোকান দিয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে।
সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সৎ উদ্দেশ্যের প্রতি কারো কোনো সন্দেহ না থাকলেও স্থানীয় ভূমি মালিকদের নিঃশেষ হয়ে যাবার কথা হয়ত যথাস্থানে পৌঁছাচ্ছে না। এখনই উচিত স্থানীয় জমির মালিকদের যথার্থ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে ন্যূনতম অংশীদারিত্বের সুযোগ সৃষ্টি করা।
আবু জাফর সাঈদ: সাবেক সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জেদ্দা
মন্তব্য করুন