আলতাফ পারভেজ
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৪, ০৭:৩৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
আলতাফ পারভেজ

পানীয় কোম্পানির গানবাজি ও তার রাজনৈতিক-অর্থনীতি

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

বাংলাদেশে কোকাকোলার ব্যবসা অনেক পুরোনো। জনসমাজে পানীয় বাজারে তারাই এক নম্বর। গ্রাম পর্যন্ত তাদের বাজার নেটওয়ার্ক আছে। বাংলাদেশ আগে থেকেই ধানের দেশ—গানের দেশ। গান এখানে জীবনের প্রাচীন এক অনুষঙ্গ। তবে কোকের ভোক্তারা কখনো এই কোম্পানিকে সংগীতঘর হিসেবে ভাবতেন না।

পাকিস্তানের কোক স্টুডিওর গান বাংলাদেশের নগরের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরা কিছু কিছু শুনেছেন। জনপ্রিয়তাও আছে তার। তবে সাধারণ বাংলাদেশিরা কোকাকোলাকে সংগীত প্রেমিক হিসেবে দেখেননি অতীতে। হঠাৎ দেখা গেল, এই কোম্পানি এদেশে সংগীত নিয়ে খুব আগ্রহী। এখন এই খাতে তারা অর্থ খরচ করছে বেজায়। তাদের গানের ‘স্টুডিও’ দর্শক-শ্রোতাদের ‘মাতাচ্ছে’। স্টেডিয়ামেও তরুণ-তরুণীদের গানের আসরে ডেকে আনছে তারা। সেই ডাকাডাকিতে ব্যস্ত ঢাকায় আবার নতুন করে যানজট হচ্ছে।

বলাবাহুল্য, কোকের এই সংগীতপ্রীতির বড় কারণ অবশ্যই এখানকার পানীয় বাজারের উদীয়মান প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু মুশকিল হলো, এতে বাংলা গান নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ ঘটেছে।

বাংলাদেশে কোমল পানীয়’র বাজারের আকার প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার। অনেক উৎপাদক থাকলেও বেশ সুবিধাজনক ‘পরিবেশে’ ড্রিকংসের কারবার করা যায় এখানে। স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা কম। দাম নিয়ে নজরদারি আরও কম। উল্টো ১০ শতাংশ হারে এই বাজার বছর বছর বাড়ছে। বাজারের এই পরিসর বাড়ার বড় একটা কারণ এখানে জনসংখ্যায় তরুণ-তরুণীদের আধিক্য। ডেমোগ্রাফির এমন একটা বিশেষ সময় অতিক্রম করছে বাংলাদেশ যখন শিশু ও বৃদ্ধের তুলনায় তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেশি। কোকের পানীয় ব্যবসার জন্য এটা দারুণ এক ‘বাজার’ এবং মোক্ষম এক সময়। কোক এই মুহূর্তটা হেলায় হারাতে চায় না।

কোকাকোলা তাদের উদীয়মান এই বাজারে দেশীয় ড্রিংকস্ ব্যবসায়ীদের কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলতে চাইছে। সেক্ষেত্রে নতুন অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে গানকে। কোকস্টুডিও-বাংলার প্রাথমিক রাজনৈতিক-অর্থনীতি এটাই। তবে এ নিয়ে আরও কিছু কথা আছে।

বাংলাদেশ সতেরো কোটি মানুষের দেশ। অর্থনীতির আকার বাড়ছে তুমুল বেগে। সম্পদ বৈষম্য বাড়ছে তার চেয়েও দ্রুত বেগে। বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে দারিদ্র্য, দূষণ ও দুর্যোগের প্রতীক হলেও অনেকে এও জানেন, এটা কোটিপতি তৈরির বিস্ময়কর এক জমিনও বটে। করোনার মধ্যেও এখানে কোটিপতি ব্যাংক হিসাব তুমুলভাবে বেড়েছে। এখানকার সমাজে অর্থনৈতিক বঞ্চনার মেরুকরণ যেভাবে তীব্র হচ্ছে তাতে করপোরেটদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো সমাজে ‘স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখা। অর্থাৎ একটা শান্তি-শান্তি ভাব হাজির রাখা। তাদের ‘ব্যবসা’ নির্বিঘ্ন রাখতে বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ ঐ ভাবমূর্তি বজায় রাখা খুব জরুরি। নাচ, গান ইত্যাদির মাধ্যমে সে রকম পরিস্থিতি তৈরি রাখা যায় সহজে। ‘কোক-স্টুডিও-বাংলা’ তাতে সাহায্য করছে। ফলে নীতিনির্ধারকরাও কোক’কে নিয়ে খুশি। তবে দারিদ্র্য-ক্লান্ত তরুণদের তো প্রতিদিন ভাওয়াইয়া বা রবীন্দ্রসংগীত শোনালে তারা ‘খাবে’ না। সেই জন্য কোকের পুঁজিতান্ত্রিক প্লাটফর্ম থেকে বৈপ্লবিক গানই বেশি দেখছি আমরা।

কোকের গণসংগীত প্রীতির ভিন্ন কারণও আছে। কারণ এই গানগুলো বেশ ‘বিপজ্জনক’ও বটে। কোকের হাতে পড়ে এগুলোর নিবীর্যকরণ ঘটছে। লেখার শেষ দিকে তার একটা হাতেকলমে উদাহরণও দিবে আমরা। আপাতত এটুকু বলা যায়, এ কাজটাও কোকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির সঙ্গে মানানসই। যে রকমটি ঘটিয়েছেন এ আর রহমান কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লোহ কপাট’ গানটি নিয়ে। কোক এবং ‘পিপ্পা’র লক্ষ্য কিন্তু এক। পিপ্পা ধরা পড়ে গেছে, কোক সেই তুলনায় অনেক স্মার্ট। বঙ্গে তরুণ সমাজকে নাচিয়ে সে হাওয়ায় ভাসছে।

এই লেখা প্রকাশের সময় বাংলাভাষীদের মধ্যে কোক-স্টুডিও বেশ অনেক ‘পণ্য’ ছেড়েছে। কোকের বিশাল লাল লোগোর আড়াল থেকে বাংলা গানের ব্যাপক ‘নিরীক্ষা’ দেখছেন সবাই। ‘পিপ্পা’র কর্তৃপক্ষের ভাষায় এসবই নাকি হাল আমলের ‘এডাপটেশন’।

ঐ এডাপটেশনের পথ বেয়ে স্থানীয় নানা লোকজ গান ও গণসংগীতকে কোক-স্টুডিও নতুন মোড়কে উপস্থাপন করছে। তাদের কম্পোজ ও ফিউশনে থাকছে মুন্সিয়ানা। রঙিন স্টুডিও, গায়ক ও যন্ত্রীদের রঙিন পোশাক-আশাক, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে হাসাহাসি, নাচানাচিতে মনে হবে চির-শান্তি আর চির-আনন্দের এক দেশে আছি আমরা। সঙ্গতকারণে কোক-বাংলার এসব ‘শিল্প-নিরীক্ষা’ স্থানীয় তরুণ শ্রোতার মনোযোগ কাড়ছে বেশ। অনেক নতুন সংগীত ‘তারকা’ পাচ্ছে ‘বাংলা’। এই তারকাদের নিয়ে বিজ্ঞাপন জগতের কর্মতৎপরতাও বাড়ছে। পেপারগুলো এসব রিভিউ করতে খুবই উৎসাহী। কারণ ‘রিভিউ’র পেছন পেছন আসছে বিজ্ঞাপন। সব মিলে ‘কোক-স্টুডিও বাংলা’ ঢাকার সংগীত জিডিপি’র গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এখন। পাকিস্তানে ‘সফল’ হওয়ার অভিজ্ঞতাও তাদের কাজে লাগছে এখানে। সকলের জানা, পাকিস্তানে কোক-স্টুডিও বাজিমাত করেছিল মূলত সুফি ধারার গানের জন্য। এটা বেশ কৌতুককরই ছিল- যে কোম্পানির মূল লক্ষ্য মুনাফা- তারা সুফি মূল্যবোধের জয়গান গাইছে!

সুফি মূল্যবোধ সচরাচর ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে মানবতার কথা বলে। কোকাকোলা কতটা মানবতার ফেরিওয়ালা আর কতটা বাণিজ্যওয়ালা সেটা ব্যাখ্যা না করলেও চলে এখানে।

কোকস্টুডি-পাকিস্তান স্থানীয় গানের জগতের অনেক প্রান্তিক ধারা এক জায়গায় জড়ো করেছিল এবং সমন্বয়বাদী দর্শনের বাড়তি আবেদন তৈরি করতে পেরেছে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও তারা মঞ্চে এনে সাহসী কাজ করেছে। এসবই ঘটেছে যখন রাজনৈতিকভাবে সেখানে বহুজনবাদ প্রায় পরাজিত। এও বেশ কৌতুককর ছিল যখন কোকাকোলার মতো পুঁজিতান্ত্রিক প্লাটফর্ম থেকে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের ‘হাম দেখেঙ্গে’র মতো বৈপ্লবিক গান বেজেছে। তরুণ শ্রোতারা সাদরে নিয়েছে এসব ‘ফিউশন’—তথা ‘এডাপটেশন’।

কোকস্টুডিও-পাকিস্তানের গানে ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং সুফি দর্শনের প্রভাব সেখানকার শাসকদের জন্যও বিশেষ উপকারী হয়েছে। কোক তাদের গানের আসরে বরাবরই দেশপ্রেমমূলক গানও রাখে, সেটাও শাসক-এলিটদের খুশি রাখে। কারণ দারিদ্র্র্যপীড়িত নাগরিকদের মাঝে প্রবল দেশপ্রেম থাকা খুবই জরুরি!

আন্তঃধর্মীয় সংঘাত এবং ধর্মীয় সহিংসতার জন্য পাকিস্তানের যে বদনাম তার বিপরীতে বহির্বিশ্বে দেশটির শান্তিবাদী ও মডারেট ব্র্যান্ডিং চায় সেখানকার শাসকরা। এ কাজের জন্য সুফি ইসলামে সহায়ক উপাদান আছে। সুফি ইসলাম যে ইউরোপ-আমেরিকার উদারনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় সেটাই বলতে চান পাকিস্তানে অনেকে। কোক তাঁদের এই চাওয়াকে ভাষা দিয়েছে। কোকের কল্যাণে ইউটিউবে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি বেশ বিপ্লবাত্মক বলতে হবে। পাকিস্তানের কোক-স্টুডিওর প্রডাকশনগুলোর কিছু কিছু দেখে আমরা কিউবায় আছি কি না সে রকম বিভ্রমেও পড়তে হয়! অথচ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পাকিস্তানের শাসক-এলিটদের কাছে ধর্মীয় সহিংসতা একটা ভালো পণ্য। সীমান্তের ভেতরে-বাইরে সুফী দর্শনবিরোধী রেডিক্যালদের ভালোভাবেই লালন-পালন করেছে তারা। বিভিন্ন এজেন্সি সেখানে ঐ ‘রেডিক্যাল’দের নানাভাবে ব্যবহার করে বিস্তর বিদেশি ‘সহায়তা’ও আয় করেছে। পাশাপাশি কোক-স্টুডিওর মতো কর্মসূচি সফল বিক্রেতা হয়েছে সুফি ইসলামের। অথচ সুফিচিন্তার জন্ম মোটেই পুঁজিতন্ত্রের ক্ষুধা মেটানোর জন্য হয়নি- বরং রাজনৈতিক-সামাজিক তাগিদ থেকে হয়েছিল। আজও সমাজে সেই তাগিদ বোধ করে মানুষ। আর মানুষের পরিবর্তন চাওয়ার ঐ বাসনাতে বাজি ধরেছে কোক। তার বাণিজ্যিক বোঝাপড়া ব্যর্থ হয়নি। যে কারণে পাকিস্তানের কোকস্টুডিওর নতুন গান ‘বাজারে এলে’ পুরো দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে শ্রোতা-দর্শককে ইউটিউবে একবার উঁকি দিতেই হয়!

কোম্পানি ও ব্র্যান্ড হিসেবে কোক অনেক বড়। বিলিয়ন ডলার কোম্পানি বলা হয় তাদের। এই ব্র্যান্ড আমেরিকার শক্তিমত্তার প্রতীকী প্রকাশও বটে। তবে সব দেশে এবং অঞ্চলে যে সফট ড্রিংকসের বাজারে তাদের আধিপত্য আছে তা নয়। বাংলাদেশে এ খাতের অন্যান্য কোম্পানি পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের তুলনামূলকভাবে বেশি ‘কমিশন’ বা ‘সুবিধা’ দেওয়ায় কোকের জন্য বাজার অতিরিক্ত প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গেছে। পাকিস্তানেও তারা পেপসির সঙ্গে পেরে উঠছিল না অনেক দিন। ভারতে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে বোভোন্তো, জয়ন্তী কোলার মতো ‘দেশী’ও পণ্য। এ রকম পরিস্থিতির মোকাবিলায় বিজ্ঞাপন বড় হাতিয়ার। তরুণদের পছন্দের প্রায় সকল মাধ্যমে বিজ্ঞাপনী অধিকার পেপসির কব্জায় ছিল দীর্ঘকাল। কোক তখন পপগানের জগতকে বেছে নেয় তরুণ ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে। কোকের দেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিজ্ঞাপনী বাজেট এত বেশি নয় যে, তারা এ খাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারে। কোক যখন কিছু বলতে চায় তখন সেটা প্রতিষ্ঠার মতো যথেষ্ট জ্বালানি থাকে তার হাতে। পাকিস্তান কোক-স্টুডির যে কোনো নতুন ‘সিজন’-এর আগে শহরগুলোর সব বিলবোর্ড তাদের দখলে চলে যেতে দেখা যেত। ‘বাংলা’তেও কমবেশি তাই হবে, হচ্ছে।

অনেকেরই এটা জানা, কোকের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পেপসিও একই লক্ষ্যে সংগীত নিয়ে আগ্রহী। বিশাল অঙ্কের সম্মানিতে মাইকেল জ্যাকসন পেপসির হয়ে কাজ করেছেন একসময়।

পণ্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রে পপসংগীতের ব্যবহার সফট ড্রিংকস উৎপাদকদের ভালো এক কায়দা। পপসংগীত এবং হালকা পানীয়ের মধ্যে তারুণ্যকে খোঁজার একটা স্মার্ট ছবি বহুকাল থেকে জনমানসে তুলে ধরার চেষ্টা আছে। ‘কোকস্টুডি’ও সেই ধারাবাহিকতায় বেশ সৃজনশীল সংযোজন। পপের সঙ্গে সুফিবাদের ফিউশন করেছে তারা! অসংখ্য দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন দর্শক তাদের গানের অনুষ্ঠান দেখছে এবং পাকিস্তানে এই পথেই তারা পেপসির বাজার হিস্যার এক অংশ নিয়ে নিয়েছে ইতোমধ্যে।

বাজার দখলে-বেদখলের যুদ্ধের অংশ হিসেবে কোকের যে অর্থ সংগীতশিল্পীদের পকেটে যায় সেটা কোমল পানীয় ভোক্তারই টাকা। ক্রেতাকে একবার সেটা দিতে হচ্ছে বোতল কেনার সময় চিনিমিশ্রিত পানির দাম হিসেবে, আরেকবার গান শোনার সময় ইন্টারনেটের খরচ হিসেবে। বর্তমানে বাংলাদেশিরা বছরে মাথাপিছু গড়ে ১৭-১৮ বোতল সফট ড্রিকংস খায়। কোকস্টুডিও-বাংলার কল্যাণে এ পরিমাণ বাড়বে নিশ্চয়ই। যেসব দেশে জনসংখ্যায় তরুণদের অংশ বেশি সেখানেই এই পণ্যের বাজার সম্ভাবনা বেশি। ‘বাংলা’ এ মুহূর্তে এই ফর্মূলাতে পড়েছে।

বাজার-পন্ডিতদের পুরোনো একটা ধারণা নগরায়ণের মাধ্যমে পানীয়ের বিক্রি বাড়ে। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, প্রবাসীদের আয় বাড়ার কারণে গ্রামাঞ্চলেও সফট ড্রিংকসের চাহিদা বাড়ছে দ্রুতগতিতে। জলবায়ুর পরিবর্তনও ড্রিংকস উৎপাদকদের জন্য সৌভাগ্যের বার্তা নিয়ে এসেছে এখানে। বাংলার অনেক গ্রামে বিশুদ্ধ পানি মিলছে না—তবে সেখানকার দোকানে কোক হাজির আছে। তাপমাত্রার আধিক্যও এই ব্যবসাকে বাড়তি উদ্দীপনা জোগাবে বলে ভাবা হচ্ছে। ধরুন, গরমে ঘামছেন? তা হলে কোক পান করুন এবং ইউটিউবে সলিল চৌধুরীর গান শুনুন!! বাজি ধরে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনে পুঁজিতন্ত্রের কোনো ভূমিকা আছে বলে বিশ্বাস করতে একদম মন চাইবে না আপনার।

তরুণদের ক্রেতা ও ভোক্তা হিসেবে কাছে টানতে উপমহাদেশে ভালো পণ্য হলো ক্রিকেট ও গান। এই দুটো জিনিস দক্ষিণ এশিয়াতে তরুণ সমাজকে আবেগে উদ্বেল করে। দুটোই নেশার মতো। সমাজে অন্যায় অত্যাচার যতই থাক, ক্রিকেট এখানে ‘জাতিকে এক কাতারে’ নিয়ে আসে তাৎক্ষণিকভাবে। মজলুম ও জুলুমকারী আনন্দের সঙ্গেই তখন পাশাপাশি আবিষ্কার করে নিজেদের। এটা দারুণ এক ‘ফিউশন’। একই কথা বলা যায়, ঐতিহাসিক লোকজ গানগুলো নিয়ে। সেগুলোর এক ধরনের শান্তিবাদী ইমেজ আছে, যা করপোরেটদের এ মুহূর্তে খুব দরকার। কিছু কিছু নিরীক্ষায় দেখা গেছে ক্রিকেটের চেয়েও গান ব্যবসা ছড়াতে ভালো কাজে দেয়। যেমন, রাজনীতিতে বহুত্ববাদ না থাকলেও বাউল বা সুফী-রকের ফিউশন বেশ ভালো রাজনৈতিক ভূমিকা রাখতে পারে করপোরেট স্বার্থে। সুফী এবং রক— উভয়ের মধ্যে খানিক বিদ্রোহী ভঙ্গি আছে। তবে কোন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে দুয়ের ফিউশন হচ্ছে সেই আলাপ না থাকাই ব্যবসার দিক থেকে ভালো! সুতরাং পাকিস্তানে যে কারণে, কোকস্টুডিও বাংলার বিনিয়োগও একই প্রয়োজনে। ‘পিপ্পা’র ‘কপাট ভাঙ্গা’র ধরনও ওরকম।

ফেব্রুয়ারি বাঙালিদের ভাষার মাস। অনেকেরই হয়তো মনে আছে এ মাসেই ‘হাজং ভাষা’র একটা গান দিয়ে কোক-স্টুডিও ‘বাংলা’য় যাত্রা। শুরু হিসেবে এটা বেশ সাহসী। এমন সাহস বাংলার সংস্কৃতির পুরোনো শক্তির জায়গারই প্রকাশ। তবে নিঃসন্দেহে ভোক্তারাই এই সাহসের চালিকাশক্তি। কোকস্টুডিও বাংলার প্রথম গানের প্রথম লাইন সেই অর্থে বেশ নজরে রাখার মতো, ‘নাসেক নাসেক হাপাল গিলা’। যার অর্থ ‘নাচো নাচো কচিকাঁচার দল’! কিন্তু পেছন ফিরে তাকালে দেখব হাজংদের জন-ইতিহাস এত বেশি আনন্দদায়ক নয়। উদ্দাম নাচের আহ্বানের মাঝে এই তথ্য অনেকের কাছেই বিব্রতকর ঠেকবে যে হাজংরা বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটা। দীর্ঘ এক উপনিবেশিক ইতিহাসের জের কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই সম্প্রদায় আজও। তারপরও আপাতত বাঙালিদের সঙ্গে হাজংদেরও নাচতে হবে।

ইতোমধ্যে যে অভিজ্ঞতা হলো তাতে বোঝা যাচ্ছে, আধ্যাত্মবাদী ধারার বাংলা গানের প্রতিও কোক-স্টুডির বিশেষ পক্ষপাত আছে। অর্থাৎ বাউলিয়ানার নতুন করে পণ্যায়ন হবে সামনে। বাংলাদেশকে আধ্যাত্মিক শান্তির সমাজ হিসেবে তুলে ধরার এ চেষ্টাকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। যদিও জীবন ও বাস্তবতা আপাতত তেমন নেই আর। কোটি কোটি মানুষকে সামান্য সস্তায় পেয়াজ-তেল-ডাল পাওয়ার জন্য তীব্র রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিসিবির ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু এখানকার মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক ক্ষুধা যে এ রকম পুঁজিতন্ত্রের সঙ্গেও বেশ মানানসই সেটাই দেখছি আমরা ‘কোক-স্টুডিও-বাংলা’র সুরে, মূর্ছনায়।

পরিস্থিতিতে ভারসাম্য আনতে কোক সলিল চৌধুরীদের দিকেও হাত বাড়িয়েছে ইতোমধ্যে। হাত বাড়ানোর চেয়ে সেই হস্তক্ষেপে আরও বেশি কিছু ঘটছে বলতে হয়।

‘হেই সামালো ধান হো…’ বাংলার অনন্য এক বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ। কেউ কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেই এ রকম সম্পদ সৃজন করা যায় না। এর জন্য একটা অভিজ্ঞতা ও অঙ্গীকারের ভেতর দিয়ে অনেককাল হাঁটতে হয়। তবে, কিছু অর্থ-কড়ির বিনিময়ে যেভাবে নির্বিঘ্নে এরকম সম্পদ কাটা-ছেঁড়া চলছে তাকে কী বলা যায়? প্রয়াত শিল্পীর বুকে ছুরি বসানো? নাকি সৃজনশীলতার নবতরঙ্গ?

বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা আইন আছে এবং হচ্ছে। প্রতিদিন শত শত আবেদন জমা পড়ছে নানা খাতের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের সুরক্ষায়। তবে আইনের সেসব প‌্যাঁচালে আপাতত নাই বা ঢুকলাম। প্রশ্ন হলো, কোনো বাণিজ্যিক সংস্থা বা তাদের সহযোগীদের দোকান-পাটে প্রয়াত সলিল চৌধুরীর ‘হেই সামালো…’ গানটির বেচাবিক্রিকে বাংলাদেশ কীভাবে দেখবে? অর্থনীতির হিসাব-পত্তরের অতিরিক্ত আর কোন বিবেচনা কি এ মোকদ্দমায় আছে? থাকা উচিত?

সলিল চৌধুরী মারা গেছেন বেশি দিন হয়নি। তাঁর জীবন ও কাজকে স্মরণ করা এখনো দুঃসাধ্য হয়ে যায়নি। এ রকম তথ্য-প্রমাণ বিস্তর আছে, ‘হেই সামালো…’ গানটি একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তা ও কাজের অংশ হিসেবেই লেখা। সলিল চৌধুরী শিল্পের সঙ্গে রাজনীতির ফিউশন করতেন। আর আজকের সংগীত-বণিক ফিউশন ঘটাচ্ছে সেই শিল্পের সঙ্গে নিজেদের কোষাগারের। নতুন এই ‘ফিউশন’-এ ঝলমলে পোশাক, লম্ফঝম্প, নজরকাড়া আলোর খেলা ইত্যাদি সবই আছে—নেই কেবল সলিলের রাজনীতি। গানটির দীর্ঘ ইতিহাস লাপাত্তা হয়ে গেল তার নবতর বেচা-বিক্রিতে। এ যেন লেনিনের চোখ তুলে হেনরি ফোর্ডের শরীরে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাপারটাকে কারিগরি দিক থেকে বেশ বিপ্লবাত্মক মনে হলেও—আসলে তা প্রতিবিপ্লব কি না?

‘ধান’ সলিল চৌধুরীর খুব প্রিয় এক শব্দ ছিল। তাঁর বহু গানে বার বার ধানের কথা এসেছে। ‘পৌষালী বাতাসে পাকা ধানের বাসে’? বা ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’…ইত্যাদি। এই যে বারবার ধান আসছে তাঁর গানে—সেটা ছিল কৃষক আন্দোলনে তাঁর যুক্ততা থেকে। ব্যাপারটা মোটেই এমন নয়, কর্পোরেট কেউ খাম ধরিয়ে দিল আর ধান নিয়ে দুই কলম লিখে ফেললাম! ‘জমি তার—লাঙল যার’—এ রকম দাবির অংশ হিসেবে এসব গানের জন্ম। এসব গান লেখা হয়েছে শ্রেণি রাজনীতির পথে হাঁটতে হাঁটতে। কর্পোরেট স্টুডিওতে নয়।

তদন্ত করলে যেকেউ দেখবেন ধান নিয়ে লেখা সলিল চৌধুরীর এই গানগুলোর অনেক কয়টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে লেখা। বাবার সঙ্গে চা বাগানে—চা বাগানে ঘুরে তিনি গানকে আত্মস্থ করেছিলেন। আর তার সঙ্গে রাজনীতির যোগ ঘটিয়েছিলেন কৃষক সমাজের ভেতর ঢুকে। তাঁর অনেক গানে ধানযুদ্ধের রক্ত লেগে আছে। চারদিকে তখন ‘তে-ভাগা’র ডাক। সোমনাথ হোরের তেভাগার ডাইরিতে এই যুদ্ধের বিস্তারিত আছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ঐতিহাসিক ওই গানগুলোকে তাদের পুরো পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সেসব একদম আড়াল করে—নবীন শ্রোতাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। এটাকে কী এক ধরনের সাংস্কৃতিক জালিয়াতি বলব? না আধুনিক ফিউশন বিদ্যা বলতে হবে? বাংলার সমাজকে ধনে-ধান্যে-পুষ্পে-ভরা দেখাতেই বোধহয় এত কিছু চলছে।

এও সত্য, সলিল চৌধুরীর বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদকে কাটাছেঁড়ায় যুক্ত আছেন আজকের দিনের ‘শিল্পী’রাই। মাংসের দোকানের লোকরা তো কাজটা করছেন না? কিন্তু, এই যে কৃষক আন্দোলনের গণসংগীত নতুন করে গাইলেন একালের শিল্পীদল—বর্তমান সময়ের কোনো গণ-আন্দোলনে কী কখনো শামিল আছেন তারা… আদৌ? বাংলাদেশে জুলুম বিরোধী কোন কৃষকসংগ্রামে এরা দু’এক কিলোমিটার হেঁটেছেন কখনো? উত্তর তাদের জানা, শ্রোতারও জানা। তাহলে এই গানের জন্য তাঁদের দরদের জায়গাটা ঠিক কোথায়? নাকি সলিলকেও তাঁর নিজেদের মতো ‘চিত্তবিনোদনে’র কর্মী ভাবলেন?

এই শিল্পীরা কি খেয়াল করেছেন ‘হেই সামালো…’ গানটির শেষের দিকে এ রকম দুটো লাইনও আছে... ‘চিনি তোমায় চিনি গো—জানি তোমায় জানি গো--সাদা হাতি কালা মাহুত…!’ কে এই ‘সাদা হাতি’? কে এই ‘কালা মাহুত’? সলিল চৌধুরী কাদের কথা বলছিলেন? সলিলের কৃষক কণ্ঠস্বর শ্রেণিশত্রু হিসেবে কোন ‘হাতি’ আর ‘মাহুত’দের চিহ্নিত করছিল?

কোন একটা গান—যা আদতে একটা কবিতা—সেটা গাওয়ার আগে পুরো গানটায় চোখ বুলানো দরকার আছে কি না? হায়, কোককর্মীদল! সলিল আপনাদের উদ্দেশ্যেই গানটি লিখেছিলেন কি না সেটাও একটু ভাবলেন না?

আজকাল এমন প্রায়ই দেখি, ঝলমলে তারকারা এক গানের এক অংশ বিশেষ অন্য গানে লাগিয়ে দিচ্ছে। ব্যাপারটির নৈতিক বৈধতা নিয়ে শ্রোতা-দর্শকদের ভাবা দরকার আছে কি না? রবীন্দ্রনাথের এক প্যারা আর কাজী নজরুল ইসলামের এক প্যারা জোড়া দিয়ে ‘নতুন’ কিছু তৈরি করার হক আমরা কোথায় পেলাম? নজরুলের গানকে রবি ঠাকুরের গানের মতো গাওয়ার মানে কী? এসব উম্মাদপনাকে হাততালি দিতেই হবে? কারো বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ নিয়ে এভাবে কাটাকাটি আর জোড়াতালি না দিয়ে নিজেদের হিম্মতে কিছু করাই কি ভালো নয়?

বাংলাদেশের মানুষ সম্পদ পাচারের বিরুদ্ধে উচ্চকিত ইদানীং। সফল না হলেও এ নিয়ে একটা লড়াই তো জারি আছে। কিন্তু দেশটির সাংস্কৃতিক সম্পদের গায়ে যে ক্রমাগত থাবা বসছে—সেটার কী হবে? তার সংস্কৃতির ইতিহাসটুকু এভাবেই কি গুম হয়ে যাবে—যেভাবে সলিলের ‘হেই সামালো…’ গুম হওয়ার পথে।

এসব যখন লিখছি, তখন সলিল চৌধুরীর আরেকটা গানের কথা মনে এলো—‘তোমার বুকের খুনের চিহ্ন খুঁজি ঘোর অন্ধকার এই রাতে..’!

হ্যাঁ, বাস্তবিকই রাত বড় অন্ধকার হয়ে নামছে চারদিকে! সলিল চৌধুরী ঠিকই অনুমান করেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতির পর বাংলার সংগীত সম্পদও লুণ্ঠিত হতে চলেছে আজ। কেউ কেউ হয়তো একে লুণ্ঠন না বলে ধর্ষণ বলবেন। (লেখাটি ফেসবুক থেকে নেওয়া)

আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস বিষয়ে গবেষক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

র‍্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু, ক্যাম্প কমান্ডারসহ প্রত্যাহার ৪

চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫.৮২ শতাংশ : বিবিএস

ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেল শিশুর

জাল স্বাক্ষরে ওষুধ বিতরণের অভিযোগ

ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আরবদের মুনাফেকি ও সুপার হিরোদের অবদান

নোয়াখালীতে ৩০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ

নিপুণের পেছনে বড় কোনো শক্তি আছে : ডিপজল

ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি জানিয়ে চবিতে সাইক্লিস্টের র‍্যালি

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আইআইইউসি প্রতিনিধিদলের সৌজন্য সাক্ষাৎ

আ.লীগ নেতার বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগ

১০

রাইসির মরদেহ কোথায়, জানাজার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত?

১১

রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ৫০ বছরের পুরোনো

১২

মসজিদে ডুকে ইমামকে যুবদল নেতার বেধড়ক মারধর

১৩

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের পরও বেঁচে ছিলেন এক আরোহী

১৪

ছেলের আত্মহত্যায় মায়ের বিষপান

১৫

অপু বিশ্বাসের অভিযোগে ৩ জনকে সতর্ক করল পুলিশ

১৬

চট্টগ্রামে সোর্সের তথ্যে বেপরোয়া পুলিশ!

১৭

মেয়রের সামনে কাউন্সিলর রতনকে জুতাপেটা করলেন চামেলী

১৮

স্ত্রীর মরদেহ বিছানায়, ফ্যানে ঝুলছিলেন স্বামী

১৯

বদলির প্রায় দুই বছরেও কর্মস্থলে অনুপস্থিত তিনি

২০
X