আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে মানুষের কাছে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে গত বছরের ৮ আগস্ট আত্মপ্রকাশ করে সাত দলের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) মঞ্চের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সরকারের পদত্যাগের একদফার আন্দোলনে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎভাবে কর্মসূচি পালন করছে জোটটি। মঞ্চের দাবি, রাজনীতিতে তাদের কারণেই সরকার পরিবর্তনের পাশাপাশি গোটা শাসন ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন-সংস্কারের ইস্যুটি এখন বিরোধী রাজনীতিরও গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। জোট নেতারা বলছেন, প্রতিষ্ঠার এক বছরে তারা বড় কিছু করতে না পারলেও সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরি ও বিকল্প উত্থানের ক্ষেত্রে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী একটা সম্ভাবনার জায়গা তৈরিতে তারা সক্ষম হয়েছেন। ফলে মঞ্চের প্রতিও মানুষের মনোযোগ এসেছে। সে কারণে বিএনপির বাইরে গণতন্ত্র মঞ্চকে আন্দোলনের প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলে দাবি জোট নেতাদের।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন- িএই সাতটি দল নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের আত্মপ্রকাশ ঘটে। শরিক দলগুলোর সারা দেশে সাংগঠনিক ভিত্তি তেমন মজবুত না হলেও নেতাদের একটা ফেসভ্যালু রয়েছে। শুরুতে এই জোটে ডাকসুর তিনজন সাবেক ভিপি ছিলেন। এসব বিবেচনায় সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে গণতন্ত্র মঞ্চকে শামিল করে বিএনপি। তবে প্রতিষ্ঠার নয় মাস পর মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায় গণঅধিকার পরিষদ। এর মধ্য দিয়ে জোটে ভাঙন দেখা দেয়। তবে সেই ধকল কাটিয়ে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনকে এগিয়ে নিচ্ছে গণতন্ত্র মঞ্চ।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুই দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আলোচনা সভা এবং আগামী বুধবার (৯ আগস্ট) মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে গণতন্ত্র মঞ্চ তার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে। মঞ্চের শরিক দলের কর্মসূচিতে বিএনপি নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও মঞ্চগত কর্মসূচি তারা এককভাবেই পালন করে। দেখা গেছে, যুগপৎ আন্দোলনে কয়েকটি জোট সম্পৃক্ত থাকলেও কর্মসূচি প্রণয়ন ও আন্দোলন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে গণতন্ত্র মঞ্চকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় বিএনপি। গণতন্ত্র মঞ্চের ৩৫ দফা ও বিএনপির ২৭ দফার ভিত্তিতেই রাষ্ট্র মেরামতের অভিন্ন ৩১ দফা প্রণয়ন করা হয়, যেটাকে যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে পরামর্শক্রমেই এক দফা আন্দোলনের দফাগুলোও ঠিক করে বিএনপি।
প্রতিষ্ঠার এক বছরে নানা কর্মসূচি পালন করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। আর যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার পর যুগপথের পাশাপাশি জোটগতভাবেও কর্মসূচি করেছে মঞ্চ। তবে অধিকাংশ কর্মসূচি ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক। এই সময়ে তারা ঢাকায় সমাবেশ, পদযাত্রা, জোনভিত্তিক একাধিক জনসভার পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা করেছে। আর ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জে সমাবেশ এবং ঢাকা থেকে রংপুর রোডমার্চ করেছে। গত মাসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখী রোর্ডমার্চের কর্মসূচি থাকলেও একদফা ঘোষণার প্রেক্ষিতে ওই কর্মসূচি স্থগিত করে মঞ্চ। তবে জোটটি ঢাকার মধ্যে যতটা ক্রিয়াশীল, ঢাকার বাইরে ততটা বিস্তৃত নয়। কেবল বিভাগীয় শহর ও কয়েকটি জেলায় জোটের সমন্বয় কমিটি রয়েছে।
আরও পড়ুন : বিজেপি এ অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আ.লীগের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী : নাড্ডা
এদিকে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা গ্রেপ্তারের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি দলের হামলার শিকারও হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২৯ জুলাই গাবতলীতে গণতন্ত্র মঞ্চের অবস্থান কর্মসূচি থেকে মঞ্চের নেতা ভাসানী অনুসারী পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক ও রাজশাহী এভারগ্রিন ডিগ্রি মডেল কলেজের অধ্যক্ষ ড. আবু ইউসুফ সেলিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই কর্মসূচি থেকে গণতন্ত্র মঞ্চের বর্তমান সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলুকে আটক করা হলেও রাতে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ঢাকা টু রংপুর অভিমুখী রোডমার্চ পালনকালে একাধিক স্থানে সরকারি দলের হামলার শিকার হন মঞ্চের নেতারা।
গণতন্ত্র মঞ্চের সফলতা প্রসঙ্গে মঞ্চের সদ্য সাবেক সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, বর্তমান শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের একটি কার্যকর বিকল্পের আকাঙ্ক্ষা ছিল। সেই জায়গাটা গণতন্ত্র মঞ্চ পূরণ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ ছাড়া সরকার পরিবর্তনের পাশাপাশি গোটা শাসন ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন ও সংস্কার যে দরকার-এই এজেন্ডাটাকে আমরাই বড় আকারে সামনে নিয়ে আসতে পেরেছি। যেটা এখন বিরোধী রাজনীতিরও একটা গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা।
তিনি আরও বলেন, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করলেও সমমর্যাদার ভিত্তিতে জোটের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে চলেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। বিএনপির সঙ্গে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য আছে সেটি নিয়ে আমরা যেমন কথা বলেছি, তেমনি যেসব বিষয়ে দ্বিমত আছে সেগুলোও গোপন করিনি। মঞ্চের দুর্বলতা প্রসঙ্গে সাইফুল হক বলেন, মানুষ গণতন্ত্র মঞ্চকে সত্যিকারের বিকল্প হিসেবে যেভাবে দেখতে চেয়েছিল সেই জায়গাগুলোর ক্ষেত্রে আমরা মানুষের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা সেভাবে পূরণ করতে পারিনি। মঞ্চের নেতারা সারাদেশে সফর করতে পারেননি, জনগণের কাছে যেতে পারেননি-এটাও একটা দুর্বলতার জায়গা।
এ ছাড়া সমগ্র জেলাগুলোতে কার্যকরী পরিচালনা কমিটি এখনো তৈরি করতে পারিনি। গণঅধিকার পরিষদ গণতন্ত্র মঞ্চ ছেড়ে চলে গেছে। এতে আমরা বিব্রত হয়েছি। পাশাপাশি গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে অনেক সমমনা দল যুক্ত হতে চেয়েছিল। নানা কারণে আমরা তাদেরকে মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত করতে পারিনি। তারা এখন এক দল, দুই দল মিলে নানাভাবে নানা জায়গায় আছেন। এসব দল এক জায়গায় দাঁড়ালে গণতন্ত্র মঞ্চ আরও অনেক বেশি কার্যকর শক্তি হয়ে উঠতে পারত। সেটা হয়নি, এটাও মঞ্চের একটা দুর্বলতা।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চ স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বিএনপির সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করছে। এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত মঞ্চের নেতারা কেউ রাজপথ ছাড়বে না।
মন্তব্য করুন