শীতজনিত রোগে হাসপাতাল-চেম্বারে রোগীর চাপ
শীতের সঙ্গে বাড়ে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের প্রকোপ। শৈত্যপ্রবাহের পর দেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে জ্বর, ঠান্ডা, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর চাপ বেড়েছে। এসব রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাবে সবচেয়ে বেশি বয়স্ক ও শিশুরা। উত্তরাঞ্চলের ঘরে ঘরে ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি। মৌসুমি রোগের সঙ্গে এবার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কভিডের প্রকোপ। গতকাল ঢাকায় এক নারীর মৃত্যুও হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে ৫ শতাংশের বেশি রোগীর নমুনায় কভিডের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যদিও এখন পর্যন্ত কভিডের নতুন উপধরন জেএন.১-এর অস্তিত্ব দেশে নেই বলে আশ্বস্ত করছেন চিকিৎসকরা। তবে আগামীতে কভিড আবারও আমাদের ভোগান্তিতে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গতকাল ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল উত্তরাঞ্চলের তেঁতুলিয়ায় ৬ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা যত কমছে, রোগের উপদ্রবও বাড়ছে। উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুরসহ দেশের অধিকাংশ জেলায় এখন শীতজনিত অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে হচ্ছে। সরকারি হিসাবে সারা দেশে গত দেড় মাসে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে শীতের কারণে। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। একটি বেসরকারি সূত্র মতে, শুধু সিলেট বিভাগের একটি জেলাতেই শীতজনিত রোগে ২৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, বয়স্ক ও শিশুদের শীতে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া উচিত নয়। শিশুদের শীতের পোশাক পরিধান করাতে হবে। সামান্য অবহেলার কারণে শিশুদের মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, গ্রামাঞ্চলে অনেকে শীতের জন্য গোসল করে না। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকে। এসব কারণে এ রোগের সংক্রমণ বেশি হয়।
রাজধানীসহ উত্তরাঞ্চলের হাসপাতালে শিশুদের চাপ সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে যেখানে ৫০০ থেকে ৮০০ রোগী ভিড় করত। এখন সেখানে প্রতিদিন ১ হাজারেরও বেশি শিশু আসছে। সরেজমিন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট ঘুরে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের সামনে শিশুদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অভিভাবকরা। দীর্ঘ সারিতে দাঁড়ানো রোগীরা এগোচ্ছেন ধীরগতিতে। অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে পড়ছে অসুস্থ শিশুরা। এই চিত্র এখন সারা দেশের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) তথ্যমতে, গত দেড় মাসে শীতজনিত রোগ নিয়ে সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ লাখ ১০৭ জন। এ হিসাবে দৈনিক গড়ে ৪ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে সেবা নিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত দেড় মাসে যে ২৫ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে, তার মধ্যে সর্বোচ্চ চট্টগ্রামে ২১ জন, ময়মনসিংহে তিন এবং রাজশাহীতে একজন রয়েছেন। অধিদপ্তরের সারা দেশে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি হবে বলে জেলা সিভিল সার্জনরা।
শিশু হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, শীতের সময় শিশুদের রোগবালাই দেখা দেয়। শিশুবিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে শীতজনিত রোগীর চাপ অনেক। শীত ও বায়ুদূষণজনিত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে আগের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ। শিশুদের অনেকে আসছে সর্দি, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া হাঁচি-কাশি নিয়ে। একটি অংশের তীব্র জ্বর, গলাব্যথা ও কাশি। দেখা গেছে, এই ধরনের রোগীদের কোনো সংক্রমণ নেই, জ্বরও নেই। কিন্তু নাক বন্ধ থাকায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, নবজাতক হলে দুধ টেনে খেতে পারে না। শিশু ঘুমাতে পারে না, কান্নাকাটি করে। বাচ্চারা শ্বাসতন্ত্রের নানা ধরনের সংক্রমণ এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এই সময় বাচ্চাদের অ্যাজমাও বেড়ে যাচ্ছে। ধূলিকণা নিঃশ্বাসের সঙ্গে শ্বাসতন্ত্রে গিয়ে ছোট-বড় সবারই ক্রনিক কাশি হচ্ছে। এসব সমস্যা শৈত্যপ্রবাহের সময় বেশি হয়।
এ সময় তিনি বলেন, শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুকে সুস্থ রাখতে মাথা ঢেকে রাখতে হবে। অহেতুক বাসার বাইরে-মার্কেটে বাচ্চাদের নিয়ে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। কাশি হলেই ফার্মেসি থেকে কিনে শিশুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, শীতে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের শ্বাসনালিতে নানা ধরনের সংক্রমণের উপদ্রব দেখা যায়। শ্বাসকষ্ট, সর্দি, কাশি লক্ষ্য করা যায়। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারিভাবে নগরীর সড়কে পানি ছিঁটানো, কনস্ট্রাকশনের কাজের নিরাপ্রটোকল বাড়ানো। রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া এবং শীতে যেহেতু বায়ুদূষণ বাড়ে, তাই রাজধানীসহ লোকালয়ের কাছের ইটভাটা বন্ধ করা দরকার।
ব্যক্তিগত সুরক্ষার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, শীতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বয়স্ক ও শিশুরা। শিশুরা শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন ভাইরাল ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। বাইরে বের হলে মাস্ক পরিধান করতে হবে। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। শীতের কাপড় পরিধান করতে হবে। এর পরও কোনো লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এদিকে শীতের সঙ্গে সঙ্গে দেশের কভিড পরিস্থিতিও অবনতি হচ্ছে। গতকাল ২১ জনের নমুনায় রোগটি শনাক্ত হয়েছে। এ সময় ঢাকায় এক নারীর মৃত্যুও হয়েছে। আগামী এপ্রিলের পর থেকে দেশে কভিড পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। তাই এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। সেইসঙ্গে ব্যক্তিগত সুরক্ষা বিষয়ে আরও জোর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, কভিড যেহেতু বাড়ছে; শনাক্তের হার ৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে একটু ঝুঁকি তো আছেই। সম্প্রতি দেশে নির্বাচন শেষ হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে মানুষ একে অন্যের সংস্পর্শে আসছে। মানুষ ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মানছে না।
১৫ জানুয়ারি, ২০২৪