খুলনায় বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে, যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত ১৩ এপ্রিল থেকে অর্থাৎ, ১২ দিন ধরে তীব্র তাপদাহ চলছে। অসহনীয় গরমে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এতে খুলনায় শিশু স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশুরা। ডায়রিয়া, জ্বর ও ঠান্ডা-গরম লাগার কারণে হাসপাতালে ছুটছেন অভিভাবকরা। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) খুলনার তিনটি বড় হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।
বুধবার (২৪ এপ্রিল) দুপুর থেকে ডায়রিয়া শুরু হয় খুলনার সোনাডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা আরাফাত হোসেনের তিন বছরের মেয়ে লামিয়ার। মেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে খুলনা শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১৫০ টাকা টিকিট কেটে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখান আরাফাত। চিকিৎসক লামিয়াকে দ্রুত ভর্তির পরামর্শ দিলেও জানান এখানে কোনো সিট নেই। পাশেই সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে। মেয়েকে কোনো রকম ভর্তি করতে পারলেও সিট তো দূরের কথা লামিয়ার স্থান হয় বারান্দার মেঝেতে। একই অবস্থা হয় নিউমার্কেটের দোকানি কর্মচারী আবুবক্করের দেড় বছরের ছেলে আইয়ানের ভাগ্যেও। ছেলেকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন কোনো সিট তো নেই। সিটের জন্য ৩০ জনের ওপরে সিরিয়াল দিয়ে রেখেছেন যাদের এখনো ভর্তি করা সম্ভব হয়নি।
শুধু খুলনা শিশু হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালই নয়; তীব্র তাপপ্রবাহে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে রোগীর চাপ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন শিশুরা। শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়া, জ্বর ও ঠান্ডা-গরম লাগার প্রবণতা বেশি।
খুলনা শিশু হাসপাতাল
বৃহস্পতিবার বিকেলে খুলনা শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, বহির্বিভাগে শিশু রোগীর স্বজনদের উপচেপড়া ভিড়। প্রতিটি শিশুর সঙ্গে একাধিক স্বজন হাসপাতালে আসায় ভিড় আরও বেড়েছে। বেশিরভাগ শিশুই ডায়রিয়া, জ্বর, ঠান্ডা-কাশিতে আক্রান্ত।
টুটপাড়া এলাকার মনির হোসেন বলেন, আজ ২ দিন ধরে বাচ্চার পাতলা পায়খানা হচ্ছে। বাড়িতে স্যালাইন খাইয়েছি, ভেবেছিলাম ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পায়খানা না কমায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। সকাল থেকে লম্বা লাইন। আরও ১১ জনের পরে আমাদের সিরিয়াল।
খুলনা শিশু হাসপাতালের ভর্তি তথ্য কেন্দ্র থেকে জানা গেছে, ২৭৫ শয্যার হাসপাতালে সাধারণ শয্যা রয়েছে ২৪৭টি। গত দুই সপ্তাহ ধরে সব শয্যাই পূর্ণ থাকছে। প্রতিদিন ৩০-৪০টি শয্যা খালি হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে একই সংখ্যক রোগী ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এমন যে, হাসপাতালে ভর্তির জন্য এখন সিরিয়াল রাখা হচ্ছে। সব সময় অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি রোগী সিরিয়ালে থাকছেন ভর্তির জন্য।
হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আল আমিন রাকিব জানান, গত ৮/১০ দিন ধরে রোগীর চাপ অস্বাভাবিক রকম বেড়েছে। আগে বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৪৫০টির মতো শিশু রোগী চিকিৎসা নিত। মঙ্গলবার চিকিৎসা নিয়েছে ৬৫০ জন। বুধবার দুপুর ২টা পর্যন্ত ৪৮২ জন চিকিৎসা নিয়েছে। সিরিয়ালে আছে আরও দেড় শতাধিক রোগী।
তিনি বলেন, হাসপাতালে শয্যার বাইরে কোনো রোগী ভর্তি করা হয় না। এ কারণে যতগুলো শয্যা ফাঁকা হচ্ছে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ভর্তি করতে না পারায় প্রতিদিন অনেক রোগী ফেরতও পাঠাতে হচ্ছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
দুপুর ২টায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, বহির্বিভাগে রোগীদের প্রচণ্ড ভিড়। আন্তঃবিভাগে ভর্তি রোগীও বেড়েছে। বুধবার খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট রোগী ভর্তি রয়েছেন ১ হাজার ৪৪৩ জন।
হাসপাতাল থেকে জানা গেছে, হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে শয্যা রয়েছে ৪৮টি। অথচ ওই ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছে ১৩৯টি শিশু। শয্যা না থাকায় রোগীর ঠাঁই হয়েছে মেঝে, বারান্দায়।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. হুসাইন শাফায়াত বলেন, শয্যা পরিপূর্ণ থাকার পরেও রোগী আসতে থাকে। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দেই কীভাবে? এ জন্য মেঝে-বারান্দায় যেখানে ফাঁকা পাওয়া যায়, সেখানে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, গরমের কারণে ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। অন্যান্য রোগী স্বাভাবিক রয়েছে।
খুলনা সংক্রমক ব্যাধি হাসপাতাল
তীব্র তাপদাহে খুলনার একমাত্র সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালেও ডায়রিয়া রোগীর চাপ বেড়েছে। নগরীর মীরেরডাঙ্গায় অবস্থিত এই হাসপাতালেও শয্যা ফাঁকা নেই। মাত্র ২০ শয্যার এই হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের জন্য শয্যা বরাদ্দ ১০টি। কিন্তু রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় সেটি বাড়িয়ে ১৪টি করা হয়েছে। তারপরও প্রতিদিন অসংখ্য রোগী ফিরে যাচ্ছেন।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. হাবিবুর রহমান জানান, তীব্র তাপপ্রবাহে রোগীর চাপ বেড়েছে। গত ২৩ দিনে হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় তিন শতাধিক রোগী। শয্যা সীমিত থাকায় রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না।
মন্তব্য করুন