

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক দিল্লি সফর সামনে রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন এক কূটনৈতিক বার্তা দিয়েছেন, যা শুধু দিল্লির নয় বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ৪ ডিসেম্বর রাতে দিল্লিতে পুতিনের বিমান অবতরণের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দরে গিয়ে প্রথা ভেঙে তাকে স্বাগত জানান। পরের দিনও পুতিনের প্রতিটি কর্মসূচি সরাসরি নিজের নেতৃত্বে পরিচালনা করেন মোদি। এ দৃশ্যমান নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে মোদি যে মূল বার্তা দিয়েছেন—তা হলো ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ‘পেছনে তাকিয়ে থাকার’ দিন শেষ। অর্থাৎ দ্বিধার রাজনীতি এখন অতীত। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে এ নতুন দৃঢ়তা আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও ভূরাজনীতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করছে।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগত কূটনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। তবে পুতিনের এ সফরকে তিনি যেভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট যে, তিনি বিশ্বশক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা না করেই ভারতের স্বার্থকে সবার আগে রেখেছেন।
কারণ, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর নিষেধাজ্ঞা, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে পুতিনের যে কোনো সফর বিশ্বমঞ্চে সমালোচিত হয়। পশ্চিমা গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকরা এমন সফরকে সমালোচনার চোখে দেখেন।
তবু পুতিনকে দিল্লিতে নিজে গিয়ে গ্রহণ করা—একটি শক্ত প্রতীকী পদক্ষেপ। অনেক সময় এ ধরনের অভ্যর্থনা প্রটোকল কর্মকর্তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়; কিন্তু মোদি তা করেননি। বরং পুতিনের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি সবার সামনে ঘোষণা করেছেন—দিল্লি আর কূটনৈতিক সমীকরণের ভয়ে সম্পর্কের পথ নির্ধারণ করবে না।
দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি প্রবণতা দেখা গেছে—বড় শক্তিগুলোর চোখ রাঙানি বা অস্বস্তির আশঙ্কায় সিদ্ধান্ত নেওয়া। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যকার টানাপোড়েনের সময় ভারত অনেক ইস্যুতে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মোদির বক্তব্য বা আচরণে এই ধারণা উঠে এসেছে যে, ভারত আর অন্যের প্রতিক্রিয়া ভেবে সিদ্ধান্ত নেবে না, দিল্লি নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে। এই পরিবর্তন আসলে ভারতের আন্তর্জাতিক অবস্থানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি, বড় সামরিক শক্তি এবং প্রযুক্তিতে দ্রুত অগ্রগতি—এসব বিবেচনায় ভারতের ‘স্বতন্ত্র কূটনীতি’ এখন বাস্তবতা।
রাশিয়া-ভারত সম্পর্ক, পুরোনো বন্ধুত্বের নতুন পাঠ: ছয় দশক ধরে রাশিয়া ভারতের অন্যতম কৌশলগত মিত্র। অস্ত্র ক্রয় থেকে পারমাণবিক সহযোগিতা, মহাকাশ গবেষণা থেকে জ্বালানির জোগান—সব ক্ষেত্রেই রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞার সময় ভারত রাশিয়ার তেল কিনে অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য সুবিধা পেয়েছে।
পুতিনের এই সফর সম্পর্কের ধারাবাহিকতারই আরেকটি অধ্যায়। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগকে ভালো চোখে দেখে না, তবু ভারত স্পষ্ট করে দিয়েছে—দিল্লির সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক পশ্চিমা বিশ্ব বা অন্য কোনো শক্তির অনুমতির ওপর নির্ভর করে না।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটেও বার্তা স্পষ্ট: ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কও বিগত দশকে ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, বাণিজ্য, প্রযুক্তি বিনিয়োগ—সব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তবে ভারত কখনো ‘জোটবদ্ধ’ কূটনীতি গ্রহণ করেনি। ভারত তাদের কৌশলকে বহুমুখী সংযোগ—এ নামে অভিহিত করে। মোদির পুতিন সফর পরিচালনার ধরন সেই নীতির পুনরুজ্জীবন। এ বার্তা যুক্তরাষ্ট্রকেও স্মরণ করিয়ে দেয়—দিল্লি স্বাধীন অবস্থান বজায় রেখে দুই পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক পরিচালনা করবে। চাপ বা সমালোচনায় এই নীতি বদলাবে না।
চীনের প্রেক্ষাপট, নতুন কৌশলগত ভারসাম্য: ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনা চলমান। এ মুহূর্তে রাশিয়া-চীন-ভারত ত্রিভুজীয় সম্পর্কও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের আলোচনায় রয়েছে। মোদির পুতিনকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার একটি কৌশলগত দিক হলো—রাশিয়া যেন সম্পূর্ণভাবে চীনের দিকে ঝুঁকে না পড়ে। মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে ভারত কৌশলগতভাবে নিরাপদ থাকে।
সফরের রাজনৈতিক গুরুত্ব: পুতিন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও একটি গুরুত্ব বহন করে—বিশেষ করে মোদির ‘বিশ্ব নেতৃত্বের’ ভাবমূর্তি তুলে ধরায়। পুতিনের মতো বিতর্কিত হলেও ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী নেতার সফর মোদিকে একটি শক্তিশালী বৈদেশিক নীতি প্রদর্শনের সুযোগ দেয়। দেশের ভেতরেও এটি তার নেতৃত্বকে বিশ্বমঞ্চে দৃশ্যমান করার একটি মাধ্যম।
সফর কী বার্তা দিল বিশ্বের শক্তিগুলোকে: বিশ্লেষকদের মতে, মোদির এ সিদ্ধান্ত বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে তিনটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—ভারত নিরপেক্ষ নয়, স্বাধীন; পররাষ্ট্রনীতি চাপ নয়, স্বার্থের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে এবং বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে প্রস্তুত।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও সম্ভাবনা: এ সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য খাতে সম্ভাব্য বেশ কয়েকটি চুক্তি নিয়ে আলোচনার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ভারত এখনো রাশিয়ার অন্যতম বড় তেল আমদানিকারক। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, পারমাণবিক শক্তি এবং মহাকাশ গবেষণাতেও যৌথ উদ্যোগ জোরদার হতে পারে। পশ্চিমা কূটনীতিকদের অনেকে পুতিন সফরকে অস্বস্তিকর মনে করলেও ভারত সফরের ধরনে কোনো পরিবর্তন আনেনি।
মন্তব্য করুন