অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে বন্ধ হওয়ার পথে দেশের অন্যতম প্রধান সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লিডস করপোরেশন লিমিটেড। এতে কোর ব্যাংকিং প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে ১৩ ব্যাংক ও ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। শিগগির জটিলতা নিরসন কিংবা বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ব্যাংকগুলোর মৌলিক লেনদেনে ব্যবহৃত সফটওয়্যারে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।
জানা গেছে, লিডস করপোরেশন ৩০ বছর ধরে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ‘কোর ব্যাংকিং’-এ প্রযুক্তি সেবা দিয়ে আসছে। কোম্পানির চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল আজিজ এবং তার ভাই শেখ আব্দুল ওয়াহিদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। দুজনই বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক। তবে সপরিবারে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে।
দেশের খ্যাতনামা অনেক প্রতিষ্ঠান লিডসের সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকে। এই কোম্পানির কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার ‘ব্যাংক আল্টিমাস’-এর মাধ্যমে লেনদেন কার্যক্রম পরিচালনা করে দেশের ১৩টি ব্যাংক ও ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তবে নানা কারণে সম্প্রতি কোম্পানিটি তীব্র আর্থিক সংকটে পড়ে। দীর্ঘদিন বেতন বকেয়াসহ নানা অনিয়মের কারণে একযোগে চাকরি ছেড়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ দেড় শতাধিক কর্মী। এতে লিডসের সেবা গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের নির্বিঘ্ন ব্যবহার নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
একযোগে দেড় শতাধিক কর্মীর চাকরি ছাড়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, লিডস করপোরেশন দীর্ঘদিন ধরে কর্মীদের বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা নিয়মিতভাবে দিতে পারছিল না। এতে কর্মীদের বেতনসহ অন্যান্য বকেয়া জমেছে ৩৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে অফিস ভবন নির্মাণ এবং ব্যবসা পরিচালনার জন্য সাউথইস্ট ব্যাংকসহ তিন ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারছে না সফটওয়্যার নির্মাতা এই প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন বেতন না পাওয়াসহ নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে লিডস থেকে গত কয়েক দিনে ১৭০-১৮০ কর্মী পদত্যাগ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির নানা অনিয়মের কারণে এর আগেও অনেকে চাকরি ছেড়েছেন। কোম্পানির আর্থিক দৈন্যের কারণে চাকরি ছাড়ার পরও অনেকের মধ্যেই পাওনা নিয়ে হতাশা বিরাজ করছে।
গতকাল সোমবার সরেজমিন মিরপুরে লিডস করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, ১০ তলা কার্যালয়টিতে কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী এবং মানবসম্পদ, প্রশাসন এবং অর্থ বিভাগের কয়েকজন ছাড়া কেউ নেই। কর্মকর্তাদের মধ্যেও তিন-চারজন বাদে কেউ অফিস করছেন না। এমনকি সফটওয়্যার কোম্পানির প্রাণ কারিগরি কর্মীরাও (টেকনিক্যাল পারসন) উপস্থিত নেই।
চাকরি ছাড়ার কারণ জানতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
সিইওর বিষয়ে জানতে চাইলে অফিসের অভ্যর্থনা বিভাগ থেকে জানানো হয়, তিনি অফিসে আসেননি। পরে অফিসে থাকা মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে যান।
অফিস থেকে বেরিয়ে আসার সময় কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, ‘গতকালও কয়েকজন অফিসে এসেছিলেন। কিন্তু আজ (সোমবার) দু-একজন ছাড়া কেউ আসেননি।’
না আসার কারণ হিসেবে তারা বলেন, ‘স্যারেরা কেন আসছেন না সেটা জানি না, তবে শুনেছি বেতন না পাওয়ার কারণে নাকি তারা সবাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।’
প্রতিষ্ঠানটির সদ্য পদত্যাগ করা চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) এস এম সাইফুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে কাজ করেছি। কিন্তু ১৫ মাসের মতো বেতন পাইনি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি মামলাসহ নানা জটিলতায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় তো আর চাকরি করা সম্ভব নয়।’
প্রতিষ্ঠানটির আরেক প্রকৌশলী জোবায়ের বলেন, ‘মূলত বেতন না পাওয়ার কারণে চাকরি থেকে সবাই পদত্যাগ করেছেন। কারণ সবারই ছয় মাস থেকে ২-৩ বছর পর্যন্ত বেতন পাওনা। এভাবে তো সংসার চালানো সম্ভব নয়।’
লিডসের বর্তমান দুরবস্থার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এনসিআর করপোরেশন নামক একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লিডস নামে কোম্পানি কিনে লিডস করপোরেশন গঠন করা হয়। এর কিছুদিন পর এনসিআর করপোরেশনের বিরুদ্ধে খান আকতার আলম নামে একজন বাংলাদেশি কর্মী বকেয়া পাওনা দাবি করে একটি মামলা করেন। দীর্ঘদিন পর ২০১৮ সালে সেই মামলার রায় দেন আদালত। এতে খান আকতার আলমকে ৩০ বছরের পাওনা বাবদ ৮৩ কোটি টাকা পরিশোধের আদেশ দেওয়া হয়। আদালত তার পাওনা আদায়ের জন্য লিডস করপোরেশনের সব সফটওয়্যার পণ্য বিক্রির জন্য নিলামে তোলেন।
জানা গেছে, নিলামে অংশ নিয়ে ফ্লোরা টেলিকমের স্বত্বাধিকারী মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম ডিউক মাত্র ৫ কোটি টাকায় লিডস করপোরেশনের সব সফটওয়্যার পণ্য কিনে নেন। লিডসের সফটওয়্যার ব্যবহারকারী সব প্রতিষ্ঠানে এই বিষয়ে চিঠিও দেয় ফ্লোরা টেলিকম। অন্যদিকে লিডস করপোরেশনকে ভবন নির্মাণ ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রায় ৮০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল সাউথইস্ট ব্যাংক। তারাও প্রতিষ্ঠানটির সফটওয়্যার পণ্যের ওপর স্বত্ব দাবি করে আইনের আশ্রয় নেয়। সেই মামলা এখন বিচারাধীন। আগামী ৪ জুলাই মামলাটির পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য রয়েছে।
এ অবস্থায় লিডসের সব ব্যাংক হিসাব স্থবির হয়ে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বেগতিক দেখে এবং পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচতে মিজানুর রহমান নামে একজন সাবেক ব্যাংকারকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক দুই ভাই আমেরিকায় গা ঢাকা দেন। এ কারণে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন আটকে যায়। দীর্ঘদিন বেতন না পেয়ে প্রায় সব কর্মীই একে একে চাকরি ছেড়েছেন। এ কারণে এই প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার ব্যবহারকারী ব্যাংকগুলো বিপাকে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ টেকনিক্যাল কর্মীরা আর ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেই। আবার সাউথইস্ট ব্যাংকের মামলার কারণে সফটওয়্যারের ওপর ফ্লোরা টেলিকমের নিয়ন্ত্রণও আটকে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ২৫০ জন কর্মী ছিলেন। এর মধ্যে বেশিরভাগই সফটওয়্যার প্রকৌশলীসহ কারিগরি কর্মকর্তা। যারা মূলত সফটওয়্যার সেবা দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে লিডসের সেবা নেওয়া ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন সফটওয়্যার সম্পর্কিত কোনো টেকনিক্যাল সমস্যার সম্মুখীন হলে সেটার সেবা তাৎক্ষণিকভাবে পাবে না। এতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে নানারকম অসুবিধার অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। এ অবস্থায় কোনো ব্যাংক বাধ্য হয়ে ব্যাকডোরে লিডস করপোরেশন থেকে চাকরি ছেড়ে যাওয়া টেকনিক্যাল এক্সপার্টদের সাহায্য নিলেও তা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এ ক্ষেত্রে কোনো টেকনিক্যাল ত্রুটি দেখা দিলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাউকে দায়ী করা সম্ভব হবে না। নিরাপত্তার জন্যও তা হুমকি হতে পারে। আবার প্রতিষ্ঠানগুলো ‘ব্যাংক আল্টিমাস’ পরিবর্তন করে অন্য কোর-ব্যাংকিং অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার কিনতে চাইলেও তা সময়সাপেক্ষ হবে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা কালবেলাকে বলেন, ‘লিডস যদি সফটওয়্যার সাপোর্ট দিতে না পারে তাহলে হঠাৎ করে সার্ভিস ডাউনটাইম বা সিস্টেম ফেইলিউরের ঝুঁকি থাকতে পারে, নতুন সিস্টেমে মাইগ্রেশন করার সময় ডাটা ব্রিচ বা সাইবার হামলার ঝুঁকি থাকতে পারে। লিডসের পরিবর্তে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সেবা নিতে গেলেও কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে।’
লিডসের ওয়েবসাইট ঘেঁটে এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের ১৩টি ব্যাংকসহ মোট ২৩টি প্রতিষ্ঠান কোর ব্যাংকিংয়ের জন্য লিডসের ‘ব্যাংক আল্টিমাস’ অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার ব্যবহার করে। এর মধ্যে রয়েছে—সাউথইস্ট, উত্তরা, শাহাজালাল ইসলামী, প্রিমিয়ার, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, মেঘনা, মধুমতি, এনআরবিসি, স্ট্যান্ডার্ড, সিটিজেনস, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। এ ছাড়া আরও ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারেজ হাউস লিডসের সফটওয়্যার সেবা নেয়।
কোম্পানিটির প্রায় সব কর্মী চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার সেবা অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সফটওয়্যার সেবা না পেলে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা, অর্থ লেনদেনসহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। এতে ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সফটওয়্যার আপগ্রেডেশনে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
এ বিষয়ে উত্তরা ব্যাংকের নির্বাহী মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘লিডসের সফটওয়্যার সাপোর্ট না পেলে ডে টু ডে অপারেশনে সমস্যা হতে পারে। সেটা হলে ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য সমস্যা হবে। কখনো সফটওয়্যার সেবা বন্ধ হয়ে গেলে পরের দিনের ট্রানজেকশন শুরু করতে সমস্যা হতে পারে। কর্মী না থাকায় হঠাৎ সমস্যা দেখা দিলে সাপোর্ট পাওয়া যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘এটা শুধু আমাদের জন্য নয় পুরো দেশের জন্য বিশাল একটি সমস্যা হয়ে যাবে। কারণ রাতারাতি তো সফটওয়্যার কোম্পানি চেঞ্জ করতে পারবো না, এক মাসে পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে এটি এখন শুধু কোম্পানির ইস্যু না, জাতীয় ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। এ ছাড়া লিডস যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে দেশের সফটওয়্যার খাতের জন্যও একটি বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। কারণ দেশীয় কোম্পানিগুলোর প্রতি আস্থার সংকট দেখা দেবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক কালবেলাকে বলেন, এই ধরনের সমস্যা বিবেচনা করেই ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি আইসিটি গাইড লাইন আছে। ব্যাংকগুলো ওই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। তবে এসব সমস্যার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যায় পড়ার কথা নয়। কারণ ব্যাংক তো সফটওয়্যারের দৈনন্দিন কাজ করে থাকে। সে ক্ষেত্রে সফটওয়্যার কোম্পানির আইটি কর্মকর্তা কমে গেলে ব্যাংকের সমস্যা হবে না। তবে ব্যাংক যদি কোনো নতুন পণ্য বাজারে ছাড়তে যায় বা নতুন করে সফটওয়্যারের আপডেট করতে যায় তাহলে সমস্যায় পড়তে হতে পারে।
এদিকে সাউথ ইস্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মিরপুর ১৪ নম্বরে একটি দৃষ্টিনন্দন টাওয়ার তৈরি করেছে লিডস করপোরেশন। তবে এই ভবন নির্মাণেও নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানিটির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, কোন দরপত্র ছাড়াই একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সহায়তায় লিডসের মালিক পক্ষ ১৫ কোটি টাকার বিল্ডিং ৪০ কোটি টাকা দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। বিল্ডিংয়ের খরচ বেশি দেখিয়ে লিডসের মালিক পক্ষ বিদেশে টাকা পাচার করেছেন বলেও অনেকেই সন্দেহ করেন।
সার্বিক বিষয়ে কথা বলার জন্য লিডস করপোরেশনের চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল আজিজ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ আব্দুল ওয়াহিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো মাধ্যমেই তা সম্ভব হয়নি।