সচিবালয়ে নজিরবিহীন হট্টগোল ও হাতাহাতির ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জনপ্রশাসনে চলমান অস্থিরতা সামাল দিতে তড়িঘড়ি করে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়ার পর তুমুল বিতর্কের মুখে দুই দিনের মাথায় গতকাল আটজনের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। রদবদল করা হয়েছে কয়েকজনের কর্মস্থল। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে বাকিদের বিষয়েও কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান। এ ছাড়া সচিবালয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তবে এসব সিদ্ধান্ত এবং সচিবের আশ্বাসের পরও অসন্তোষ নিরসনের তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি গতকাল পর্যন্ত। বরং ৫৯ ডিসি নিয়োগ দিয়ে জারি করা দুটি প্রজ্ঞাপনই বাতিলের দাবি জানিয়েছেন পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা। অর্থাৎ নতুন নিয়োগ পাওয়া সব ডিসির নিয়োগ বাতিল চান তারা। দাবি পূরণের জন্য বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩০-৪০ জন গতকাল সকালে জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব বিভাগের বিভিন্ন কক্ষে প্রবেশ করে কর্মকর্তাদের চাপ দিয়েছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে। এ সময় তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কক্ষে তালা দেওয়ার উদ্যোগও নেন। ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের অসন্তোষের জেরে মঙ্গলবারের মতো গতকালও সচিবালয়ের পরিস্থিতি ছিল কিছুটা উত্তপ্ত।
এদিকে, নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির পেছনে সরকারের একজন উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দায়ী করেছেন ক্ষুব্ধ কর্মকর্তরা। তাদের দাবি, বিগত সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়া এবং সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কাজ করছেন ওই উপদেষ্টা। তবে কালবেলার কাছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওই উপদেষ্টা।
নানা উদ্যোগেও জটিলতা কাটেনি: ডিসি নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের জেরে গতকালও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সচিবালয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তাদের ক্ষোভ দমনের জন্য সদ্য নিয়োগ পাওয়া আট ডিসির নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। এ তথ্য জানিয়ে গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, একটি বাছাই কমিটির মাধ্যমে ডিসি নিয়োগের ফিটলিস্ট হয়। সেই কমিটি আজকে (গতকাল বুধবার) বসেছিল। পর্যালোচনা করে ইমিডিয়েট যেটা হয়েছে, ইতোমধ্যে ৮ জনের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। চারজনের কর্মস্থলও পরিবর্তন করা হয়েছে। এ ছাড়া সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অন্যদেরও নিয়োগ বাতিল হবে বলে জানান তিনি।
এর আগে সমালোচনার মুখে মঙ্গলবার রাতেই এক আদেশে পদায়ন করা ডিসিদের কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে আপাতত পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানের নির্দেশনা দেওয়া হয়। গতকাল পর্যন্ত তাদের ব্যাপারে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। এর ফলে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারাও আছেন ধোঁয়াশার মধ্যে। তবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় এখনই এ নিয়ে মন্তব্য করছেন না তারা।
বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হলেও প্রশাসনের সর্বস্তরে সুতার সরকারের সুবিধাভোগীদের পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।
বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পক্ষে তাদের সমন্বয়ক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নূরুল করিম ভূঁইয়া কালবেলাকে জানান, ডিসি নিয়োগের দুটি প্রজ্ঞাপনই বাতিল চান তারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
অসন্তোষের দায় কার: মাসখানেক ধরে ব্যাপক যাচাই-বাছাই করে ফিটলিস্ট তৈরির পরও ডিসি পদে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা কী করে নিয়োগ পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জনপ্রশাসনে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কিত করতে এবং বেকায়দায় ফেলতে সুচিন্তিতভাবেই এমন বিতর্কিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও সন্দেহ করছেন অনেকে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানায়, ডিসি নিয়োগের জন্য ব্যাপক যাচাই-বাছাই করে ফিটলিস্ট তৈরি করা হলেও শেষ পর্যস্ত সেই সুপারিশ আর কার্যকর থাকেনি। এই পুরো প্রক্রিয়ার কলকাঠি নেড়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা। এর আগেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিগত সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পুনর্বাসনের অভিযোগ উঠে ওই উপদেষ্টার বিরুদ্ধে।
অভিযুক্ত উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কালবেলাকে তিনি বলেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বাধীন পাঁচজন সচিবের স্বাক্ষরে ডিসিদের পদায়ন হয়। এখানে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, সেহেতু আটজনের নিয়োগ বাতিল হয়েছে। নিয়োগ নিয়ে জনপ্রশাসনে হট্টগোলের বিষয়েও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে দিয়ে কমিটি করা হয়েছে। যারা হট্টগোল করেছেন, তারা শৃঙ্খলা বঙ্গ করেছেন।
সূত্র জানায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ আমলে টানা ১৫ বছর ধরে বঞ্চিত মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি এবং পদায়নের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু এক উপদেষ্টা যোগ্য, মেধাবী ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদানে শুরুতেই বাধা হয়ে দাঁড়ান। শুধু তা-ই নয়, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে নিযুক্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীনদের সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি ছিল তার। আওয়ামী লীগ আমলে সাজানো প্রশাসনে কোনো ধরনের পরিবর্তনে সম্মত ছিলেন না তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত নানা চাপের কারণে কয়েকদিন পর এসব পদে রদবদল আনা হয়।
বঞ্চিতদের অভিযোগ, ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচনে সহায়তাকাকারী ইউএনও, ডিসি, এসপি ও বিভাগীয় কিমিশনারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের পুনরায় পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তিনি। সর্বশেষ ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া তালিকায় সেটি ফুটে ওঠে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদারের সঙ্গে। কালবেলাকে তিনি বলেন, ডিসি পদায়নের বিষয়টি মোটেই চৌকসভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি। জনপ্রশাসন নিয়ে প্রথম বড় সিদ্ধান্তেই এমন বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় বিষয়টি সরকারের জন্য ভালো হয়নি। জনপ্রশাসন সচিবকে এ বিষয়ে আরও সতর্ক হতে হবে। তাকে দায় নিতে হবে। হাতে ধরে কাজ করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এর পূর্বাপর তাকে তিনবার ভাবতে হবে।
ডিসি নিয়োগ কেন্দ্র করে সচিবালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে একটি কালো দাগ হিসেবে অভিহিত করে সাবেক এই আমলা বলেন, আশা করি ভবিষ্যতে এমনটি আর ঘটবে না।
নিয়োগ বাতিল যাদের: নবনিযুক্ত লক্ষ্মীপুরের ডিসি সুফিয়া আক্তার রুমী, জয়পুরহাটের মো. সাইদুজ্জামান, কুষ্টিয়ার ফারহানা ইসলাম, রাজশাহীর মো. মাহবুবুর রহমান, শরীয়তপুরের মো. আবদুল আজিজ, সিরাজগঞ্জের মোহাম্মদ মনির হোসেন হাওলাদার, রাজবাড়ীর মনোয়ারা বেগম এবং দিনাজপুরের মো. মোবাশশেরুল ইসলামের নিয়োগ বাতিল হয়েছে। এদের অনেকেই অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ম্যান’ দাবি করে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছিলেন।
যোগদানের আগেই কর্মস্থল বদল চারজনের: জনপ্রশাসন সচিব গতকাল জানান, কাজের দক্ষতা বিবেচনায় নিয়ে চার জেলার নবনিযুক্ত ডিসিকে বদল করা হয়েছে। টাঙ্গাইলের ডিসি সাবেত আলীকে পঞ্চগড়ে, নীলফামারীর ডিসি শরিফা হককে টাঙ্গাইলে, নাটোরের ডিসি রাজীব কুমার সরকারকে লক্ষ্মীপুরে এবং পঞ্চগড়ের ডিসি নায়িরুজ্জামানকে নীলফামারীতে বদলি করা হয়েছে।
সচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যে কোনো জায়গায় যদি আরও সমস্যা থাকে যেটা ভ্যালিড, ক্লাসিফাইড এবং আনবায়াসড, এটা চলমান প্রক্রিয়া। আপনারা ইতিহাসে দেখেছেন, একদিনের ডিসি, একদিনের কমিশনার কিংবা একদিনের সচিবও হয়েছেন অনেকে। সুতরাং অভিযোগ সুনির্দিষ্ট হলে ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।
তদন্ত কমিটি গঠন: ডিসি নিয়োগকে কেন্দ্র করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হাতাহাতির ঘটনায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে দায়িত্ব দিয়ে কমিটি গঠন করেছে সরকার। কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তারা ঘটনা তদন্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রতিবেদন জমা দেবেন। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের শাস্তি দেবে সরকার।
৭ মন্ত্রণালয়ে সচিব নিয়োগ শিগগির: সচিব শূন্য ৭টি মন্ত্রণালয়ে শিগগিরই সচিব নিয়োগ দেওয়ার আভাস দিয়েছেন জনপ্রশাসন সচিব। তিনি বলেন, আমরা দ্রুত এ পদগুলো পূরণ করব। আসলে প্রশাসনে কাজ করার মতো যোগ্য কর্মকর্তার অভাব দেখা দিয়েছে। এজন্য যাছাই-বাছাই করতে আমাদের সময় লাগছে। ৭ জনের নিয়োগে কাউকে চুক্তিভিত্তিক নেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নে মোখলেস উর রহমান বলেন, আমরা সার্ভিসে রয়েছে এমন অতিরিক্ত সচিবদের মধ্য থেকেই সচিব নিয়োগ দেব। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আর হবে না।