অন্তর্বর্তী সরকারের মাঠ প্রশাসনে চরম হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের দেড় মাসেরও বেশি সময় পার হলেও শৃঙ্খলা ফেরেনি নতুন এ সরকারের প্রশাসনে। অস্থিরতা ও বিতর্কও পিছু হটছে না। বিশেষ করে ডিসি নিয়োগ নিয়ে নানা কেলেঙ্কারি; নিয়োগের পরপরই আবার বাতিল ও রদবদল; প্রত্যাহারের এক মাসের বেশি সময় পরও আট জেলায় ডিসি নিয়োগে ব্যর্থতা; কয়েকটি জেলায় পতিত সরকারের ডিসি বহাল থাকা এবং বিগত সরকারের সময় বঞ্চিত ও যোগ্য কর্মকর্তাদের পদায়ন নিশ্চিত করতে না পারাসহ নানা কারণে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) ভূমিকাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
প্রশাসনের এমন দুরবস্থার জন্য কখনো প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে নিয়োজিত একজন উপদেষ্টা এবং গোয়েন্দা সংস্থার ওপর দায় বর্তানোর চেষ্টা করেছেন বোর্ডের সদস্যরা।
তবে মাঠ প্রশাসন নিয়ে এমন বিতর্কের জন্য এসএসবি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ অনুবিভাগ এপিডিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এসএসবি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে মাঠ প্রশাসন নিয়ে এমন বিতর্ক ও অস্থিরতা এড়ানো যেত। অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলতে প্রশাসনে কোনো কিছু হচ্ছে কি না সেটিও খতিয়ে দেখার পরামর্শ তাদের।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নিয়ে প্রশাসনের দিকে মনোযোগ দেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। শুরুতেই পতিত সরকারের আমলে বঞ্চিত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। এরই মধ্যে মাঠ প্রশাসন সাজাতে গিয়ে ৫৯টি জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) প্রত্যাহার করা হয়। এরপর এসব জেলায় নতুন ডিসি পদায়ন নিয়ে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। তিন দফায় ৫৯ জেলায় ডিসি নিয়োগের পর নানা বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে ৯ জেলা থেকে ডিসি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে চারজন ডিসিকে ফের রদবদল করা হয়। পতিত হাসিনা সরকারের বৈষ্যমের শিকার হওয়া বঞ্চিত কর্মকর্তাদের তোপের মুখে পড়েন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডির যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তা। এই ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগেই আরেক কর্মকর্তার রুমে তিন কোটি টাকার চেক পাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার তদন্তেও কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এভাবেই একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে আছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে শেখ হাসিনার আস্থাভাজন কর্মকর্তারা বহাল এবং নতুন করে মাঠ প্রশাসনে আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের ডিসি হিসেবে পদায়ন করায় এমন ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, ডিসি হিসেবে পদায়নের জন্য দায়িত্ব পালন করে এসএসবি। কর্মকর্তাদের মৌখিক পরীক্ষা, এসিআর, গোয়েন্দা প্রতিবেদনসহ নানা বিষয় বিবেচনার ভিত্তিতেই এ তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী এ বোর্ডকে সাচিবিক সহায়তা দেওয়ার দায়িত্ব জনপ্রশাসনের এপিডি মো. আব্দুর রউফের। কিন্তু পুরোটা প্রক্রিয়ায় তিনি ছিলেন নিষ্ক্রিয়। তাকে এসব কাজে ডাকা হতো না বলে জানা গেছে। অন্যদিকে বোর্ডের সদস্য না হয়েও প্রটোকল ভেঙে প্রতিটি এসএসবি সভা এবং ফিটলিস্টের ভাইভায় যুগ্ম সচিব আলী আযম উপস্থিত ছিলেন। এমনকি দুর্ঘটনায় অসুস্থ হয়ে হুইলচেয়ারে চড়ে এসব সভা ও পরীক্ষায় উপস্থিত ছিলেন প্রভাবশালী এ কর্মকর্তা। ডিসি নিয়োগে সার্বক্ষণিক প্রতাপ খাটানো এই কর্মকর্তা যে কোনো কাজে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের দোহাই দিতেন।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পদায়ন করা ৫৯ জন ডিসির মধ্যে ৮ জনই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের বহাল থাকা মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং এসএসবির প্রধান মাহবুব হোসেনের বিভাগের। বোর্ডের বিশেষ সদস্য ও স্বাস্থ্যসচিব আকমল হোসেন আজাদের মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ পান ৭ জন। ডিসি তালিকার ২৫ শতাংশই দুই মন্ত্রণালয় থেকে কেন হবে, তা নিয়ে সবখানেই প্রশ্ন ওঠে। এ ছাড়া নিয়োগ পাওয়া ডিসিদের মধ্যে অন্তত ৫৬ জন আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট, শেখ হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী ও বিতর্কিত বলে গণমাধ্যমে উঠে আসে, যা নিয়ে প্রশাসনের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক তোলপাড় হয়। সমালোচনা ও প্রশ্ন তৈরি হয় ডিসি নিয়োগের এই বোর্ডকে নিয়েই। শুধু তাই নয়, পতিত সরকারের সুবিধাভোগীদের ডিসি নিয়োগের প্রতিবাদে হট্টগোল করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয় বোর্ডের বিতর্কিত বিশেষ সদস্য ও স্বাস্থ্য সচিব আকমল হোসেন আজাদকেই, যা নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে আরও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে আকমল হোসেন আজাদ কর্মকর্তাদের সঙ্গে চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করেন। ১৫ মিনিট থেকে প্রায় ৩০ মিনিট ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় বসতে দেননি কর্মকর্তাদের। এমনকি নারী কর্মকর্তাদেরও বসতে দেননি তিনি। এ সময় ডিসি নিয়োগে নিজের ভূমিকা পাশ কাটিয়ে প্রধান উপদেষ্টা এবং তার কার্যালয়ে নিযুক্ত এক উপদেষ্টার ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেন স্বাস্থ্য সচিব। অন্যদিকে ডিসি নিয়োগে এসএসবির সুপারিশকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে নানা মাধ্যমে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়া যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাদের বাইরে রেখে বিতর্কিতদের পদায়নে প্রশাসনের সব জায়গায় বিতর্কের মুখে এরই মধ্যে যুগ্ম সচিব আলী আযমকে সরিয়ে দিয়ে সিলেটের অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে বদলি করা হয়েছে।
বঞ্চিতদের অভিযোগ, ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচনে সহায়তাকাকারী ইউএনও, ডিসি, এসপি ও বিভাগীয় কমিশনারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ফের পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন গত সরকারের প্রভাব থাকা দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবুল আলম মো. শহীদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘নতুন সরকারের প্রশাসন সাজাতে সম্প্রতি করা ডিসি লিস্ট নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক চলছে সন্দেহ নেই। সাধারণত নানান বিষয় বিবেচনায় নিয়েই ডিসি ফিটলিস্ট তৈরি করা হয়ে থাকে। এ তালিকা চূড়ান্ত করার সময় অবশ্যই সেসব বিষয় প্রধান্য দেওয়া উচিত। তবে নিয়োগ তালিকায় আর্থিক সংশ্লিষ্টতা খুব কনফিউজিং ব্যাপার। বিষয়টি তদন্তে বেরিয়ে আসবে।’
সার্বিক বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পদোন্নতিপ্রাপ্তদের পদায়নের কাজ চলছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন এলেই পদায়ন শুরু হবে। একটু অপেক্ষা করুন, গোটা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। দীর্ঘ দুঃশাসনের পরিবর্তনের পর একটু সমস্যা হবেই। এটা প্রশাসনিক কাজে বাধা হওয়ার মতো কিছু নয়।’