চলতি বছর আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করবে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পুরোনো তথ্যেই প্রকাশ করা হবে এবারের হালনাগাদ করা চূড়ান্ত ভোটার তালিকা। তবে আগামী মার্চের পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা করার কার্যক্রম শুরু করবে সংস্থাটি। গতকাল সোমবার এএমএম নাসির উদ্দীন নেতৃত্বাধীন কমিশনের প্রথম কমিশন বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, মার্চের পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে করা ওই ভোটার তালিকা দিয়েই ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী চাপের মধ্যেও আগামী জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ এখন পর্যন্ত ঘোষণা করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। তবে সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ এবং কোনো কোনো উপদেষ্টা ২০২৬ এর জুন-জুলাই নাগাদ নির্বাচন হতে পারে বলে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন। দলগুলোর চাওয়া অনুযায়ী, এরই মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিয়েছে সরকার। এটিকে সরকারের নির্বাচনী যাত্রা হিসেবে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। আর এ কমিশনের প্রথম বৈঠকেই ভোটার তালিকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়াকে নির্বাচনের আরেক ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘ভোটার তালিকা নতুন কমিশনের অ্যাসিড টেস্ট। কারণ, এটি নির্বাচনের প্রথম ধাপ। এ তালিকা গ্রহণযোগ্য ও বিতর্কমুক্ত না হলে পুরো কমিশনের সব কার্যক্রমই বিতর্কিত হবে, যা দেশের জন্য আরও বিপদ ডেকে আনতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভোটার তালিকা নতুন কমিশনের প্রথম চ্যালেঞ্জ। সেজন্য কমিশনকে চব্বিশের বিপ্লব ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে ভোটার তালিকা করতে হবে। গতানুগতিকভাবে দায়সারা কোনো তালিকা করলে হবে না। তালিকা থেকে ভুয়া ভোটার বাদ দিতে হবে। যাতে তালিকা আপামর জনসাধারণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। এর মধ্য দিয়ে কমিশন প্রথম পরীক্ষায় পাস করার সুযোগ পাবে।’
ইসি সূত্র জানায়, আইন অনুযায়ী, প্রতি বছর ২ জানুয়ারি হালনাগাদ ভোটার তালিকার খসড়া এবং ২ মার্চ চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করতে হয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর সময় কম হলেও এ কমিশন তার ব্যত্যয় ঘটাতে চায় না। সেজন্য প্রথম কমিশন বৈঠকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার বিষয়টি যেহেতু সময়সাপেক্ষ, সেহেতু এবার পুরোনো তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে যেহেতু নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, সেহেতু হালনাগাদ তালিকার পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে করা তালিকাকেই জাতীয় নির্বাচনের ভোটার তালিকা হিসেবে ভাবা যেতে পারে।
কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ভোটার এখন ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ২১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৭ জন; আর নারী ভোটার পাঁচ কোটি ৯৭ লাখ ৪ হাজার ৬৪১ জন। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন ৯৩২ জন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীনের সভাপতিত্বে সকালে আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত সভায় অন্য চার কমিশনার, ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে চার কমিশনারের নেতৃত্বে চারটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে হালনাগাদ ভোটার তালিকা হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত ১৭ লাখ তথ্য আমাদের হাতে রয়েছে, যেটা জানুয়ারি ২০২৫ সালে আমরা সন্নিবেশ করব এবং তারা নতুন ভোটার হিসেবে তালিকায় যুক্ত হবেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এই তথ্যটা পূর্ণাঙ্গ হয় না। কারণ অনেকেই অফিসে এসে নিবন্ধন সম্পন্ন করেননি। আনুমানিক ৪৫ লাখ হতো এই সংখ্যাটা। আমাদের হাতে যে ১৭ লাখ তথ্য আছে, তার মধ্যে ১৩ লাখ আমরা ২০২২ সালে সংগ্রহ করেছি। আর বাকি ৪ লাখ আমাদের বিভিন্ন অফিসে এসে এ বছরে নিবন্ধন করেছে। অর্থাৎ আমাদের ধারণা, ২৭ থেকে ২৮ লাখ ভোটার, কমবেশি হতে পারে; কিন্তু ভোটার হওয়ার যোগ্য। এই বাস্তবতায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের এই বছরে যে প্রক্রিয়া, এই প্রক্রিয়ায় হালনাগাদটা সম্পন্ন হবে।
তিনি বলেন, ১ জানুয়ারি যে তথ্যটা ভোটারযোগ্য হয়ে যায়, সেই তথ্যটা আমরা ২ জানুয়ারি থেকে ২ মার্চের মধ্যে শুনানিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম করে চূড়ান্ত করে থাকি। ২০২৫ সালের ২ মার্চ এটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে এবং তালিকা প্রকাশ হবে। কিন্তু যারা বাদ পড়লেন আমরা চাই তারা ভোটার তালিকায় যুক্ত হোক। এজন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের তথ্য সংগ্রহ করব। এই বাদ পড়া ভোটাররা ছাড়াও ২০২৫ সালে যারা ভোটার হবেন অর্থাৎ ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য হবেন তাদের তথ্যও আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করব। এর মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের তালিকাটা চেক করে নিতে পারব।
আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কার্যক্রম সম্পন্ন করতে আমাদের আনুমানিক ছয় মাস সময় লাগবে। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে শতভাগ শুদ্ধতার সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা প্রকাশ করা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হালনাগাদ কবে শুরু হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা যত দ্রুত সম্ভব এটা করব। ২ মার্চের পরেই শুরু করতে পারব বলে আশা করি। বিস্তারিত সময়সূচি ইসি সচিবালয় ঠিক করবে।
বৈঠকে চারটি কমিটি গঠনের বিষয় তুলে ধরে এই নির্বাচন কমিশনার জানান, গঠিত চারটি কমিটির মধ্যে এনআইডি, ভোটার তালিকা, নির্বাচন ব্যবস্থা ও তথ্য প্রযুক্তিবিষয়ক কমিটির প্রধান তিনি নিজে। এ ছাড়া আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটির প্রধান আবদুর রহমান মাসুদ; সীমানা পুনর্নির্ধারণ, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন প্রস্তুতি, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও তদারকি কমিটির প্রধান আনোয়ারুল ইসলাম সরকার; নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রশাসনিক সংস্কার ও দক্ষতা উন্নয়ন কমিটির প্রধান হিসেবে বেগম তহমিদা আহমদ দায়িত্ব পালন করবেন।
কমিশনারদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ: নির্বাচন কমিশনারদের জ্যেষ্ঠতার ক্রম নির্ধারণ করল সরকার। গতকাল কমিশনারদের নামের বানান ও জ্যেষ্ঠতার ক্রম নির্ধারণ করে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। প্রজ্ঞাপন অনুসারে ক্রমিক-১ হচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আব্দুর রহমানের মাছউদ। ক্রমিক-২ হচ্ছেন সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তাহমিদা আহমদ, ক্রমিক-৩ নম্বরে হচ্ছেন মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার এবং ক্রমিক-৪ হচ্ছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
গত ২১ নভেম্বরের নিয়োগের প্রজ্ঞাপনে ১ নম্বর ক্রমিকে ছিলেন মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার। ২ ও ৩-এ ছিলেন আব্দুর রহমানের মাছউদ ও বেগম তাহমিদা আহমদ। আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ আগেও ৪ নম্বর ক্রমিকে ছিলেন।