সফটওয়্যার শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পের মতো ঝুঁকিপূর্ণ; কিন্তু সম্ভাবনাময় খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইক্যুইটি অ্যান্ড এন্টারপ্রেনিউরশিপ ফান্ড (ইইএফ)। ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এ ফান্ডের টাকা উদ্যোক্তাদের হাতে যাওয়ার কথা। তবে ঘটেছে উল্টোটা। পতিত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ প্রভাবশালীরা এ ফান্ডের টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছেন। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য অনেকে প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণ নেন। তবে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই এখন হদিস নেই। তথ্য বলছে, রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা ইইএফ ফান্ডের অপব্যবহার করেছেন। এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া বকেয়া টাকা তুলতেও লুটপাট করেছেন আইসিবির কর্মকর্তারা। টাকা উদ্ধার এবং ফান্ড দেখভালে প্রকল্প ভিজিটের নামে টিএডিএ খরচ দেখিয়ে প্রায় ৭ কোটি টাকা সম্মানী নিয়েছেন কর্মকর্তারা। জিএম থেকে শুরু করে সব স্তরের কর্মকর্তারাই নিয়েছেন এ সম্মানী। এর বাইরে বিভিন্ন মিটিংয়ের সম্মানী ভাতা হিসেবেও নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ টাকা।
কালবেলার হাতে আসা নথিপত্র বলছে, প্রায় ১৮১ জন কর্মকর্তা টিএডিএ হিসেবে টাকা নিয়েছেন। এর মধ্যে ২২ লাখ থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকাও রয়েছে। তালিকায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ২১ লাখ ৭০ হাজার ৪৪০ টাকা সম্মানী নিয়েছেন আইসিবির জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) আল আমিন তালুকদার। একই সঙ্গে আল আমিন তালুকদার বিপুল টাকা নিয়েছেন মিটিংয়ের সম্মানী বাবদও। তথ্য বলছে, ইইএফ ফান্ডের এসব কারসাজির নেতৃত্ব দিয়েছেন (জিএম) আল আমিন তালুকদার। তিনি টিএডিএ এবং প্রকল্প পরিদর্শনবাবদ বিপুল টাকা নেওয়ার পাশাপাশি ঘনিষ্ঠজনদেরও বিপুল টাকা নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। মূলত পতিত সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে এসব কাজে নেতৃত্ব দিলেও বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নজর দেয়নি।
আল আমিন তালুকদার ছাড়াও এজিএম এসএম মজিবুর রহমান নিয়েছেন ১৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা, প্রিন্সিপাল অফিসার মাসুদ মিয়া নিয়েছেন ১৪ লাখ, ডিজিএম আবুবকর সিদ্দিক নিয়েছেন ১১ লাখ টাকা, ডিজিএম রফিকুল্লাহ নিয়েছেন ১৫ লাখ ১ হাজার টাকা, ডিজিএম ফারুকুল ইসলাম নিয়েছেন ১০ লাখ ৫২ হাজার টাকা, ডিজিএম নাসিম আহমেদও নিয়েছেন প্রায় ১০ লাখ টাকা এবং সিনিয়র অফিসার জাহিদুল ইসলাম নিয়েছেন প্রায় ১০ লাখ।
এ ছাড়া তিন এজিএম নিয়েছেন যথাক্রমে ১৯ লাখ ৩৩ হাজার, ১১ লাখ এবং ১৬ লাখ ২০ হাজার, সদ্য অবসরে যাওয়া একজন সাবেক জিএম নিয়েছেন ১৪ লাখ ১০ হাজার, দুজন সিনিয়র প্রিন্সিপাল নিয়েছেন প্রায় ১১ লাখ টাকা করে। অন্য এক প্রিন্সিপাল অফিসার নিয়েছেন প্রায় ১১ লাখ টাকা। এর এর বাইরে ডিজিএম থেকে শুরু করে সিনিয়র অফিসার পদমর্যাদার আরও দশজন কর্মকর্তা ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। এ ছাড়া এজিএম থেকে শুরু করে সিনিয়র অফিসার পদমর্যাদার আরও ৩২ জন কর্মকর্তা নিয়েছেন ৫ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত। অন্তত ৪৯ জন কর্মকর্তা নিয়েছেন ২ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। এভাবে আইসিবির প্রায় ১৮১ জন কর্মকর্তা ইইএফ ফান্ড দেখভালের নামে ৭ কোটি টাকার মতো সম্মানী নিয়েছেন।
তথ্য বলছে, ইইএফ ফান্ডের টাকা আদায় না হলেও কর্মকর্তাদের সম্মানী ভাতা নেওয়ায় বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার অনেকেই বলছেন, টিএডিএ বিল নেওয়ার ক্ষেত্রেও অর্থকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নিজেদের মতো করে বড় বড় অঙ্কের টাকা নিয়েছেন কর্মকর্তারা। আবার টাকা উদ্ধারে বিভিন্ন মিটিংয়ের নামেও বিপুল টাকা সম্মানী নিয়েছেন। সেখানেও ব্যত্যয় ঘটেছে নিয়মের। কারণ যেই ফান্ড দেখভাল এবং বকেয়া উদ্ধারের জন্য মিটিং, সেই প্রকল্পে আদতে কোনো অগ্রগতি নেই। গত তিন থেকে সাড়ে তিন বছরে বিপুল পরিমাণ টাকা কর্মকর্তারা পকেটস্থ করলেও টাকা উদ্ধারে তৎপরতা নেই বললেই চলে।
দেশে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০১ সালে জামানতবিহীন এবং সুদমুক্ত একটি বিনিয়োগ কর্মসূচি চালু করে সরকার। প্রথম দফায় ১০০ কোটি টাকা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ইক্যুইটি অ্যান্ড এন্টারপ্রেনিউরশিপ ফান্ড’ (সমমূলধন উদ্যোক্তা তহবিল, সংক্ষেপে ইইএফ) গঠন করে। বর্তমানে এই তহবিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত এই তহবিল থেকে মোট ২ হাজার ৬৩টি প্রকল্পে ৩ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি ও তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাত এবং শেয়ার ফেরত নেওয়ার (বাই-ব্যাক) শর্তে ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি ও আইসিটি খাতের ১ হাজার ৩৯টি প্রকল্পে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ৫১৯ কোটি টাকা। বাকি টাকার প্রায় পুরোটাই লুটেপুটে খেয়েছেন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
বিধিবিধানে বলা হয়, সরকারের কাছ থেকে ৫১ শতাংশ বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য উদ্যোক্তাকে কোনোরকম জামানত দিতে হবে না; সুদ বা কোনো লভ্যাংশও দিতে হবে না। শুধু আট বছরের মধ্যে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া টাকা ফেরত দিলেই হবে। কিন্তু কেউ যদি ফেরত না দেয়, তাহলে কী হবে? এখানেই রয়ে গেছে শুভংকরের ফাঁকি। ঋণ নিয়ে কেউ তা ফেরত না দিলে তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে বিষয়ে বিধিমালায় কিছুই বলা হয়নি। আর এই ফাঁক ব্যবহার করেই উদ্যোগটির বিপুল পরিমাণ অর্থ সাবাড় করে দিয়েছেন সুযোগসন্ধানীরা।
জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম পাঁচ বছরে ২৩৬টি প্রকল্পে ৫৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। যার মধ্যে ২০টি প্রকল্প থেকে মাত্র ৪০ কোটি টাকা আদায় হয়। ওই সময় ইইএফে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে তৎকালীন গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগ বন্ধ রাখেন। পরে ২০০৯ সালের জুন মাসে এই তহবিলের বিনিয়োগে সাব-এজেন্সি হিসেবে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে বিধিবিধান সব আগের মতোই রাখা হয়।
নীতিমালা অনুযায়ী আট বছরের মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও সেই সময়সীমা পার করা প্রকল্পের সংখ্যা ৭৪৭টি। এগুলোতে সরকার থেকে বিনিয়োগ করা হয়েছে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ৪৭৪ কোটি। বাকি ৭৮৬ কোটি টাকার হদিস নেই। এ ছাড়া তিন থেকে আট বছরমেয়াদি ২৮২টি প্রকল্পে বিনিয়োগ রয়েছে ৩৫১ কোটি; আদায় হয়েছে মাত্র ২৭ কোটি টাকা। বাকিটা সাবাড় হয়ে গেছে। কিন্তু নীতিমালার কারণে অর্থঋণ আদালতে যেতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা আইসিবি।
গত বছর আইসিবি জাতীয় সংসদের কাছে ১৯৮টি প্রকল্পের পরিদর্শন প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। এতে বলা হয়েছে, ৫৭টি প্রকল্প উৎপাদনে, ৭৫টি আংশিক উৎপাদনে, ৪৭টি স্থবির এবং ১৮টি প্রকল্পের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর অনিয়মের কারণে যে তৎকালীন গভর্নর চার বছর পর্যন্ত বিনিয়োগ বন্ধ রাখেন, সে তথ্যও আইসিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান আবু আহমেদ কালবেলাকে বলেন, এটা তো অনেক আগের বিষয়। আর আমি আইসিবিতে নিয়োগ পেয়েছি মাত্র দুই মাস হলো। এ বিষয়টি আমিও শুনেছি। এখন এটা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে সবকিছু বেরিয়ে আসবে এখানে কী হয়েছে।