আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৫, ০২:৫৪ এএম
আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৫, ১০:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দেড়শ স্কুলকে কেউ ‘পছন্দ’ করেনি

স্কুলে ভর্তিতে লটারি পদ্ধতি
দেড়শ স্কুলকে কেউ ‘পছন্দ’ করেনি

সিলেট সদরের পশ্চিম সদর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে আসন রয়েছে ১ হাজার ৩২০টি। কিন্তু লটারি পদ্ধতিতে ভর্তির বেলায় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে পছন্দ করেনি একজন শিক্ষার্থীও। একই জেলার সাহেবের বাজার হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১ হাজার ৪৫টি আসন থাকলেও কোনো শিক্ষার্থী এটিকে তাদের পছন্দক্রমে রাখেনি। এমন আরেকটি প্রতিষ্ঠান শেরপুর সদরের চরখার চর উচ্চ বিদ্যালয়। সেখানে ৬৬০টি আসন থাকলেও শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় এটি নেই। তিন প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা লটারি পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছেন না।

শুধু এ দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, সারা দেশের ১৪৮টি বেসরকারি স্কুলে প্রায় ২৯ হাজার আসন থাকলেও কোনো শিক্ষার্থী এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য চয়েসই দেয়নি। শুধু উপজেলা বা জেলা পর্যায় নয়, খোদ রাজধানীর স্কুলও আছে এই তালিকায়। অন্যদিকে, সরাসরি ভর্তির ক্ষেত্রে নামকরা হাতেগোনা কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে ছিল, লটারি পদ্ধতিতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

জানা গেছে, চলতি বছর স্কুল ভর্তির ক্ষেত্রে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চারটি শাখায় ১ হাজার ৮৬৭ আসনের বিপরীতে ৩৩ হাজার ৫৭৯টি, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের তিনটি শাখায় ৩ হাজার ১৯০টি আসনের বিপরীতে ৪৩ হাজার ২১৫টি, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে ৯১২টি আসনের বিপরীতে ২১ হাজার ১৭৬টি, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজে ৬১০টি আসনের বিপরীতে ৯ হাজার ৮৭৩টি, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজে ২২০টি আসনের বিপরীতে ৬ হাজার ৭০০টি, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৪৮৩ আসনের বিপরীতে ৫ হাজার ৫৭২টি, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ৭৯২ আসনের বিপরীতে ৭ হাজার ৭০৮টি, চিটাগাং আইডিয়াল হাই স্কুলে ২২৫টি আসনের বিপরীতে ৫ হাজার ৭২৩টি, কুমিল্লা মডার্ন হাই স্কুলে ৫৮৫ আসনের বিপরীতে ৫ হাজার ৩৭৩টি আবেদন জমা পড়েছে।

করোনা মহামারির কারণে ২০২১ সালে দেশের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে লটারি পদ্ধতি চালু হয়। এ পদ্ধতিতে অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে স্কুল পছন্দক্রম দেয় শিক্ষার্থীরা এবং লটারির মাধ্যমে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের স্কুল নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। করোনার পর থেকে প্রতি বছর স্কুলগুলোতে এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, স্কুল ও শিক্ষার্থীর সমতা বিধানে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে লটারি পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। যদিও সরকারি স্কুলগুলো এই পদ্ধতি অনুসরণ করলেও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানই এই প্রক্রিয়ায় আসেনি। শুরু থেকেই এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তিতে নামকরা স্কুলগুলোকে বেশি সুবিধা দেওয়ার অভিযোগও করেছিল অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ। তবে সেসব অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সূত্রে জানা গেছে, এবছর চার ভাগের প্রায় তিন ভাগ আসন ফাঁকা রেখেই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মাউশিকে না জানিয়েই সরাসরি ভর্তি করাচ্ছে।

জানতে চাইলে শেরপুর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রেজুয়ান কালবেলাকে বলেন, গ্রামীণ এলাকা হওয়ায় এখানে শিক্ষার্থী কিংবা তাদের অভিভাবকরা অনলাইনে আবেদন করার সঙ্গে খুব বেশি পরিচিত নন। এ ছাড়া অনেক অভিভাবক টাকা দিয়ে আবেদন করতে রাজি নন। বছরের শুরুতে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হলেও লটারির কাজ শুরু হয় নভেম্বরে। সেদিকে অভিভাবকরা খেয়ালই রাখেন না। এসব কারণে শেরপুরে শূন্য পছন্দক্রম দেওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হয়ে থাকতে পারে।

রাজধানীর প্রতিষ্ঠানের অবস্থা যেমন:

মিরপুরের আলহাজ্ব মধু বেপারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩২০টি আসন থাকলেও পছন্দক্রম শূন্য। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মীর আব্দুল মালেক কালবেলাকে বলেন, এখানে নিম্ন আয়ের মানুষের ছেলেমেয়েরা পড়ে। তারা অনলাইনে আবেদন করতে জানে না। সে কারণে আসনের বিপরীতে আবেদন শূন্য দেখাচ্ছে। এজন্য আমরা সরাসরি ভর্তি করাচ্ছি।

রাজধানীর দনিয়া এলাকার বর্ণমালা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩ হাজার ৫২৫টি আসন থাকলেও আবেদন করেছেন মাত্র ৩২০ জন। সেজন্য তারা ম্যানুয়ালি শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে তারা আসনের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে। জানতে চাইলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. ওয়াহিদুজ্জামান সিজু কালবেলাকে বলেন, আমাদের ৪ হাজারের মতো শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। তিন শতাধিক শিক্ষার্থী অনলাইনে পছন্দ দিলেও এর মধ্যে দুইশর বেশি শিক্ষার্থী আমাদের স্কুলে এসেই কম্পিউটারে আবেদন করেছে। এর মানে হলো, তারা লটারি প্রক্রিয়ায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।

একই এলাকার আসকর আলী ও কোব্বাত মিয়া (এ.কে) উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আসন রয়েছে ৪ হাজার ৩৩টি। কিন্তু আবেদন পড়েছে মাত্র ১৪৩টি। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, অনলাইনে যেসব আবেদন পড়েছে তার মধ্যে মাত্র ২৩-২৪ জন ভর্তি হয়েছে। মূলত লটারি প্রক্রিয়া আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ করে দিচ্ছে।

ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৩ হাজার ৫৪০টি আসন থাকলেও আবেদন পড়েছে মাত্র ১২৯টি। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ বাগ্ময়ী দত্ত কালবেলাকে বলেন, এটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। আমরা আসনগুলো অনলাইনে দিয়ে দেই। যারা আবেদন করে তাদের ভর্তি করাই। বাকিরা ম্যানুয়ালি ভর্তি হয়। আবেদন কম হওয়ার পেছনে লটারি পদ্ধতির সঙ্গে সবার সম্পৃক্ততায় অনীহা বড় কারণ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

জানতে চাইলে মাউশির সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-১) এস. এম জিয়াউল হায়দার হেনরী বলেন, কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আসন শূন্য থাকলে পুনরায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে লটারির আয়োজন করতে হয়। সরাসরি ভর্তির সুযোগ নেই। দেড়শ প্রতিষ্ঠানে পছন্দক্রম শূন্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। অতিরিক্ত ভর্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের এসব বিষয় জানানো হয় না। ভর্তিতে অনিয়ম খুঁজতে ঢাকা মহানগরীতে ১৭টি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তারা প্রতিবেদন দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মাউশির এক কর্মকর্তা বলেন, লটারি কোনো আদর্শ ভর্তি পদ্ধতি হতে পারে না। এটি কোনো র্যাফেল ড্র নয়। এই পদ্ধতি উঠিয়ে দেওয়া উচিত। সরকারের এ বিষয়ে সুদৃষ্টি দরকার।

মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খান কালবেলাকে বলেন, আমি মাত্র দায়িত্ব পেয়েছি। তাই এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের মাধ্যমিক-২ অনুবিভাগের অতিরিক্ত-সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. হুমায়ুন কবীরকে গত কয়েকদিন মুঠোফোনে কল ও মেসেজ পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিলে তিনি দেখেও সাড়া দেননি। আর বিদেশে থাকায় সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের মন্তব্য নেওয়া যায়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) অধ্যাপক ড. এম আমিনুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি সম্পর্কিত নই। এ বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মজিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ক্যাচমেন্ট এলাকা অনুযায়ী ভর্তি করাটা জরুরি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই নিয়ম আছে, বাড়ির নিকটবর্তী স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি হবে। সেজন্য স্কুলের শিক্ষক, অবকাঠামো, মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মান বাড়াতে হবে। এজন্য শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এগুলো না করে হুটহাট বিক্ষিপ্ত সিদ্ধান্ত নিলে এটি ফলপ্রসূ হবে না। তিনি বলেন, আমরা যৌক্তিক কোনো সমাধান যখন পাচ্ছি না, তখন বলছি, লটারি করে ভাগ্য অনুযায়ী যে যেই স্কুল পাবে, সেখানেই ভর্তি হবে। এটি তো কোনো ভালো পদ্ধতি নয়। নীতিনির্ধারণী মহলকে বিষয়গুলো আগে জানতে হবে, এরপর যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘৯ মাসেও গণহত্যাকারী দল নিষিদ্ধ হলো না কেন’

বাদ জুমা বড় জমায়েতের ডাক হাসনাত আবদুল্লাহর

এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা / নিহত ৪ জনের দুজন ছিলেন মসজিদের ইমাম

রাতে শিবির মাঠে নামায় পাল্টে গেল দৃশ্যপট

যমুনার সামনে রাতভর যা যা হলো

কয়টি রাফায়েল আছে ভারতের, একেকটির দাম কত?

ফের গোলাগুলি শুরু, উত্তেজনা তুঙ্গে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে নাক গলাতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র

দুপুরের মধ্যেই আ.লীগকে নিষিদ্ধের দাবি ড. মাসুদের

সকালেও বিক্ষোভ চলছে যমুনার সামনে

১০

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছে কোমলমতি শিশুরা

১১

আগুনে ঘি ঢালা নয়, শান্তি চাই : এরদোয়ান

১২

শুক্রবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৩

আরব সাগরে ভারতের অভিযান, টার্গেটে পাকিস্তান

১৪

০৯ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৫

০৯ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৬

অবশেষে গ্রেপ্তার সাবেক মেয়র আইভী

১৭

১৭ দিন পর রাজশাহী পলিটেকনিকে খুলল তালা

১৮

শেখ হাসিনার পক্ষে শিক্ষার্থীদের স্লোগান, প্রধান শিক্ষককে শোকজ

১৯

স্বাস্থ্য পরামর্শ / মায়ের গর্ভেই থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয় পদ্ধতি

২০
X